অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Wednesday, October 2, 2019

গল্প-সব হারানোর ব্যথা - সুধাংশু চক্রবর্তী

সব হারানোর ব্যথা

সুধাংশু চক্রবর্তী

Image Courtesy : Google Image


রাত্রের শেষ লোকাল ট্রেনে চেপে বৈকুণ্ঠপুর থেকে বাড়ি ফিরছেন যজ্ঞেশ্বর । গিয়েছিলেন এক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে । ট্রেন বসার পর স্ত্রী মন্দারের কথা মনে পড়লো তাঁর । ইস্, আজ অনেক রাত হয়ে গেল । বেচারী বাড়িতে একলা রয়েছেন । আজকাল একটাই ভয় তাড়া করে ফেরে যজ্ঞেশ্বরকে । স্ত্রীর কাছে কেউ এক জন নেই যে, হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তার ডেকে আনবে । একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে ট্রেন থেকে নেমেই দ্রুত হাঁটতে থাকলেন বাড়ীর পথ ধরে ।

বাড়ীর অনতিদূরেই রয়েছে বিশাল একটা খেলার মাঠ । সেই মাঠের পাশ দিয়ে আসার সময় বাতাসে ভেসে আসা চাপা গোঙ্গানির আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন । আওয়াজটা ভেসে আসছে মাঠের অন্ধকারাচ্ছন্ন বুক থেকে । কেউ নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েছে ! এদিকে আবার সাপখোপের বড়ই উপদ্রপ । কাউকে সাপে কাটলো না তো ! যজ্ঞেশ্বর দ্রুত চলে এলেন গোঙ্গানি লক্ষ্য করে । এসে ছোট্ট পকেট টর্চের আলোয় দেখেন বছর চোদ্দর একটি মেয়ে মাঠের মাঝখানে অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় পড়ে থেকে ছটফট করছে নিদারুণ যন্ত্রণায় । দ্রুত কাঁধের ঝোলা থেকে জলের বোতল বের করে মেয়েটির মুখের সামনে ধরে বললেন, ‘জলটুকু খেয়ে নাও মা।’

মেয়েটি ওই অবস্থাতেই ছিটকে সরে গিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলে উঠলো, ‘তোমাদের পায়ে পড়ি, আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা ।’

নিঃসন্তান সৌমেনের বুকের ভিতরটায় মোচড় দিয়ে উঠলো । আহা রে, না জানি কতই না পাশবিক অত্যাচার হয়েছে কচি মেয়েটির ওপর । ধর্ষিতা মেয়েটিকে গুছিয়ে নেবার সময় দিয়ে যজ্ঞেশ্বর গলায় সহানুভূতি মিশিয়ে বললেন, ‘তোমার বাড়ি কোথায় মা ?’
- ‘আমি বড়রাস্তার মোড়েই একটা ঝুপরিতে থাকি এক পাতানো কাকীর সাথে । আমার মা-বাবা নেই ।’ বোঝা গেল সামান্য হলেও মেয়েটির ভয় কেটেছে ।
- ‘ভয় পেয়ো না মা । আমি তোমার বাবার মতো । যারা তোমার ক্ষতি করেছে তাদের চেনো তুমি ?’
- ‘চিনি । ওই এলাকারই বড়লোকের দুটো বখাটে ছেলে । ঘুমিয়েছিলাম । কাকীমার পাশ থেকে জোর করে তুলে এনেছে আমাকে ।  কাউকে বলে দিলে আমাকে জানে খতম করে দেবে বলে শাসিয়ে গিয়েছে ।’ মেয়েটি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো ।
- ‘তোমার কোনো ভয় নেই মা । থাক, ওদের নাম বলতে হবে না তোমাকে । এখন চলো দেখি আমার সাথে ।’
- ‘কোথায় ?’
- ‘আমার বাড়িতে ।’
- ‘কিন্তু আমি যে অপবিত্র হয়ে গিয়েছি ! ওরা যে আমাকে......’ কথাটা অসমাপ্ত রেখে মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ।
- ‘দূর বোকা মেয়ে । নর্দমার কাদা গায়ে লাগলে কেউ কি অপবিত্র হয়ে যায় ? বাড়িতে গিয়ে ভালো করে স্নান করে নিবি । ব্যাস, শরীরে লেগে থাকা সব নোংরা ধুয়েমুছে গিয়ে একেবারে পবিত্র হয়ে যাবি ।’ যজ্ঞেশ্বর ওর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দেন ।
- ‘তোমরা আমাকে মেনে নিতে পারবে বাবা ? সমাজ তোমাদের কিছু বলবে না ?’

নিঃসন্তান যজ্ঞেশ্বরের গলা বুজে এলো আবেগে, ‘ওরে, তুই আমাকে বাবা বলে ডেকেছিস তাতেই আমি ধন্য হয়েছি । সমাজের কথা বলছিস ? যে-সমাজ মেয়েদের আব্রু রক্ষা করতে পারে না, যে-সমাজ নিগৃহীতাকে দোষারোপ করে সেই সমাজকে আমি ধিক্কার জানাই । শোন মেয়ে, তোর এই বাবা যতকাল বেঁচে থাকবে তোকে বুক দিয়ে আগলে রাখবে । এবার ওঠ । বাড়ি যেতে হবে না ? তোর মা যে বসে আছেন আমাদের ফেরার পথ চেয়ে ।’

যজ্ঞেশ্বর বাড়ি এসে সব কথা খুলে বললেন স্ত্রীকে । মন্দার সব শুনে মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আজ থেকে তুই আমাদের মেয়ে হলি মা । হেসেখেলে গান গেয়ে এই সংসারটা ভরিয়ে রাখবি । আমি তোকে নতুন একটা নাম দিলাম । আজ থেকে তোর নাম হবে মৃন্ময়ী ।’

পোড়াকপালি মেয়েটা নতুন একটা নামের সঙ্গে মা-বাবা পেয়ে খুব খুশী । দু’হাত দিয়ে মন্দারকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তাই হবে মা । তোমরা আমাকে মৃণ্ময়ী বলে ডেকো ।’ 

বছর খানেক পর । আজ রথ । যজ্ঞেশ্বরের হাত ধরে মৃন্ময়ী এসেছে দূরের এক রথের মেলায় । বিশাল মেলাপ্রাঙ্গন হাজার মানুষের ভিড়ে জমজমাট । যজ্ঞেশ্বর মেয়েকে সমস্ত আনন্দের উপকরণ জুগিয়ে চলেছেন হাসিমুখে । মৃণ্ময়ীকে যখন নাগরদোলায় চাপিয়েছেন ঘটনাটা তখনই ঘটলো । সহসা কী একটা কারণে যেন জোর ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল গোটা মেলা প্রাঙ্গন জুড়ে । মৃন্ময়ী একলা চেপেছে নাগরদোলায় । ওকে নাগরদোলায় চাপিয়ে যজ্ঞেশ্বর গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কিছুটা দূরে । ধাক্কাধাক্কির জেরে দূরে ছিটকে গেলেন । তারপর থেকে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছেন না মৃন্ময়ীকে ।

যজ্ঞেশ্বর সেই থেকে গোটা মেলা প্রাঙ্গন জুড়ে খুঁজে চলেছেন নিজের হারানো মেয়েকে । এদিকে রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে । একসময় ভাঙ্গন ধরলো মেলায় । ভাঙ্গা মেলায় তেমন মানুষজন নেই । যারা আছে তারা দ্রুতহাতে গুছিয়ে নিচ্ছে যে–যার অবিক্রিত পসরাসামগ্রী । দু-চারজন সুযোগসন্ধানী মানুষের দেখাও মিলছে এখানে সেখানে । যদি ভাঙা মেলায় কিছু পেয়ে যায় জলের দরে । এদের মাঝেই যজ্ঞেশ্বরকে দেখা গেল ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে যেতেও মৃন্ময়ীর সন্ধানে ছুটে মরছেন মেলার এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্ত । মানুষটা দ্রুত একজন অসহায় বাপ হয়ে উঠেছেন এই ভাঙা মেলায় । তাঁর শরীরের সমস্ত রক্ত ঘাম হয়ে ঝরতে থাকে হাজার মানুষের পদদলিত বিবর্ণ ঘাসের বুকে । তিনি তবুও ছুটে চলেছেন মেলার এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্তে ।

চোখের জলে নাকের জলে একাকার হয়ে আছে তাঁর সব হারানোর ব্যথায় কালো হয়ে যাওয়া মুখ । খোঁজার মাঝেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছেন নাগরদোলার শেষ দু-চারটে কারিগরের কাছে, দোকানের মনিব ও ব্যাপারীদের কাছে । দাঁড়িয়ে পড়ে বর্ণনা দিচ্ছে, ‘ফর্সা , একহারা চেহারা......চাপা নাক......হাত দুটিতে বড়সড় গোছের রঙ্গিন কাঁচের চুড়ি....আজ মেলাতেই কিনে পড়েছে.....আমি যে ওর পোড়া কপালে বাপ.........।’ তাঁর সেই বর্ণনায় যে-সুর ঝরে পড়ছে তা বড়ই করুণ । সোজা এসে বিঁধে যাচ্ছে যে শুনছে তার বুকের ঠিক মধ্যিখানে ।

দেখেশুনে কেউ কেউ পাগল ভেবে হাসাহাসি করছে । অনেকেই আবার না শোনার ভান করে ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের পসরা গুছোনোর কাজে । তারপর একসময় নাগরদোলা, মেলা, হৈচৈ সবকিছু হারিয়ে গেল পাথুরে স্তব্ধতার আড়ালে । ঝড়ে বিধ্বস্ত যজ্ঞেশ্বরের সামনে পেছনে পড়ে থাকলো শুধু ন্যাড়া মাঠ । সহসা একপাল হাওয়া ছুটোছুটি জুড়ে দিলো ফাঁকা মেলাপ্রাঙ্গনের বুকে । তাতেই যজ্ঞেশ্বরের বাঁধভাঙা কান্নার শব্দ মিলিয়ে যেতে থাকলো দুরন্ত বাতাসের শন্‌ শন্‌ শব্দের আড়ালে । একসময় হতাশ হয়ে, নাকের জলে চোখের জলে একাকার হয়ে, সন্তান হারানোর বুক ভাঙা আর্তনাদ সম্বল করে যজ্ঞেশ্বর বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন । পূব আকাশ তখন রঙ বদলাতে শুরু করেছে ।

যজ্ঞেশ্বর বাড়ি ফিরে এসে দেখেন, বাড়ীর খোলা দরজায় সেঁটে আছে মন্দারের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কালো মুখ । পাশে উদ্বিগ্ন মৃন্ময়ীর মুখ । দেখেই প্রায় ছুটে এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন যজ্ঞেশ্বর, ‘তুই ফিরে এসেছিস মা ? ওদিকে আমি যে কত করে তোকে......।’

মৃন্ময়ীও কান্না চাপতে না পেরে বাপের বুকে লেপটে থেকে কান্নাজড়ানো গলায় বলে, ‘ভিড়ের চাপাচাপিতে তোমাকে যে হারিয়ে ফেলেছিলাম বাবা । কিছুক্ষণ খুঁজেও ছিলাম তোমাকে । না পেয়ে চলে এসেছি বাড়িতে । রাত গভীর হবার আগেই চলে এসেছি আমি ।’

মন্দার কান্নাভেজা গলায় বললেন, ‘দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় দু’দণ্ড স্থির হয়ে বসতে পারছিলাম না । এখন যাও, চোখেমুখে জল দিয়ে এসো । চা খেয়ে একটু গড়িয়ে নাও বিছানায় । আজ আর অফিসে যেতে হবে না তোমাকে ।’

ক্লান্ত শ্রান্ত যজ্ঞেশ্বর মেনে নিলেন স্ত্রীর কথা । স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চোখেমুখে জল দিয়ে এসে চা খেয়ে সোজা চলে এলেন বিছানায় । মৃন্ময়ী এসে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো । নিশ্চিন্ত যজ্ঞেশ্বর, হারানো ধন ফিরে পাওয়া যজ্ঞেশ্বর একসময় তলিয়ে গেলন গাঢ় ঘুমে ।


আরও বছর দশেক পর । মৃন্ময়ী এখন আর সেই মৃন্ময়ী নেই । বাপ-মায়ের স্নেহ ভালোবাসা এবং মাথার নিশ্চিন্তের ছাদ পেয়ে মেয়েটা এতোদিনে খুবই সুন্দরী হয়ে উঠেছে । তাকালে চোখ ফেরানো যায় না । মেয়েকে আজ পাত্রস্থ করতে চলেছেন যজ্ঞেশ্বর । সুচাকুরে পাত্রটি তাঁরই সহকর্মীর সন্তান । সব জেনেশুনেই রাজী হয়েছে মৃন্ময়ীকে বিবাহ করে ঘরে তুলতে । যজ্ঞেশ্বর যেন দম ফেলারও অবকাশ পাচ্ছেন না । অন্যান্য এয়োস্ত্রীদের নিয়ে মন্দারও মেতে রয়েছেন স্ত্রী আচার নিয়ে । যজ্ঞেশ্বর একলার হাতে সবদিক সামলাচ্ছেন চোখের জল সামলাতে সামলাতে ।

বিবাহ আসরে বসে পুরোহিতমশাই সরঞ্জাম গোছাতে গোছাতে হাতের কাছে কিছু একটা বস্তু না পেয়ে যজ্ঞেশ্বরের কাছে চাইলেন । যজ্ঞেশ্বর দ্রুত কদমে ঘরে এসে ঢুকলেন । এখন একটি মুহূর্তও নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না । পাত্রপক্ষ চলে আসবে যে-কোনো সময়ে । হাতে আর বেশী সময় নেই । পুরোহিতের চাওয়া বস্তুটা নিতে ঢুকেছেন এই ঘরে । এখনেই তো রেখেছিলেন সেই বস্তু । কোনোদিকে তাকানোর সময় পর্যন্ত নেই । ঘরে ঢুকে এদিক সেদিক হাতড়াতে লাগলেন বস্তুটা হাতে পাবার আশায় । কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছেন না কোথায় রেখেছেন । গোছানো সরঞ্জামগুলো আগোছাল হতে লাগলো খোঁজার তাড়নায় । যজ্ঞেশ্বরের ভ্রুক্ষেপ নেই তাতে । হঠাৎ শুনলেন কে যেন বলে উঠলো, ‘কি খুঁজছো বাবা ?’

যজ্ঞেশ্বর চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন । বিয়ের কনের সাজে সেজে একটি মেয়ে ! তাঁর চোখমুখ দেখে বোঝা গেল মেয়েটিকে চিনতে পারছেন না । মেয়েটি আবার শুধোলো, ‘কি খুঁজছো বাবা ? আমাকে বলো এখনি খুঁজে দিচ্ছি ।’

যজ্ঞেশ্বর অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলেন মেয়েটির চাঁদপানা মুখের দিকে । কনের সাজে মেয়েটিকে ভারি সুন্দরী দেখাচ্ছে ! আহা, অমন একটি মেয়ে যার ঘরে আছে না জানি সে কত ভাগ্যবান !
- ‘ও বাবা, আমার দিকে অমন করে তাকিয়ে আছো কেন ? কি হয়েছে তোমার ? ও বাবা, শরীর খারাপ লাগছে ?’

বাবা’ ডাক শুনতে শুনতে বাস্তবে ফিরে এলেন যজ্ঞেশ্বর । ছিঃ-ছিঃ। নিজের মেয়েকেই চিনতে পারছিলেন না ! অথচ এই মৃন্ময়ীর জন্যই আজ এতো আয়োজন, এতো ব্যস্ততা ! ছিঃ-ছিঃ । এই লজ্জা তিনি রাখবেন কোথায় ? মেয়েটিকে একদিন অন্ধকার মাঠ থেকে তুলে এনে নিজের সংসারে ঠাই দিয়েছিলেন । বিগত বারোবছর ধরে নিজের ঔরসজাত সন্তানের মতো লালনপালন করলেও ঘর-সংসার ভুলে এতোকাল কেবল কাজ আর কাজ করে গিয়েছেন বলেই কি মৃন্ময়ীর দিকে তেমন করে তাকানোর সময় করে উঠতে পারেননি ? যজ্ঞেশ্বরের দু’চোখে জল জমতে শুরু করলো । ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা চোখে তাকালেন মৃন্ময়ীর মুখের দিকে । অমনি বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো কিছু একটা হারানোর ভয়ে । কি হারানোর ভয়ে বুকে কাঁপন ধরেছে বুঝতে না পেয়ে দঁড়িয়ে রইলেন পাথরের মূর্তি হয়ে ।

মৃন্ময়ী কাছে এসে যজ্ঞেশ্বরের বুকে মাথা রেখে ভয়ার্ত গলায় শুধোলো, ‘কি হয়েছে বাবা ? অমন করছো কেন ?’

যজ্ঞেশ্বর আর স্থির থাকতে পারলেন না । মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন হাউ হাউ করে । এই ‘বাবা’ ডাক শোনার জন্য আজ থেকে তাঁকে যে প্রতীক্ষা করে বসে থাকতে হবে । নিজেও জানেন না আবার কবে শুনবেন এই ‘বাবা’ ডাক । এটা কি সব হারানো নয় ?


।। সমাপ্ত ।।

| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
  | Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
|Special Puja Issue,2019 | September-October, 2019 |
| Third Year Third Issue |20Th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |



গল্প-পুঁজি - প্রতীক কুমার মুখার্জি



পুঁজি

প্রতীক কুমার মুখার্জি
Image Courtesy: Google Image Gallery



চার নম্বর অটোটার পিছনে দৌড়ে গিয়েও কোন লাভ হলনা - নির্ধারিত চারজনের জায়গায় ইতিমধ্যেই পাঁচজনে চড়ে বসেছে। বাসগুলোর দিকে তাকানোই যায়না, মৌচাকে থিকথিক করা মৌমাছির মতো উপচে পড়া ভিড় নিয়ে যেন রাগে গর্জন করতে করতে অফিসমুখো মানুষ নিয়ে ছুটছে। মহানগরের ‘অফিস টাইম’ - যে সময়টা শুধু ঊর্ধ্বশ্বাসে সামনের দিকে তাকিয়ে দৌড়নোর জন্য বরাদ্দ!!

পকেটে অবশ্য ট্যাক্সি ভাড়া একশো টাকা জোর করে দিয়ে দিয়েছেন মা, সঙ্গে ঠাকুরের প্রসাদী ফুল। কিন্তু জোয়ান ছেলে সে, ট্যাক্সির পিছনে খরচ করতে প্রবৃত্তি হয়না। একটা ইন্টারভিউ এরই তো ব্যাপার - প্যানেলে ঢুকে গেছে অভিনব, আজই যা হবার হয়ে যাবে। বিমলকাকু আশ্বাস দিয়েছেন। আজ কোনমতে উৎরোতে পারলেই তাদের অভাবের সংসারের অন্তত একটা হিল্লে হতে পারে।

বাবার রোগক্লিষ্ট শরীরে বার্ধক্য থাবা বসিয়েছে অকালে। মা সংসারের হাল ধরে অনেক দেনা করে ছেলেকে কয়েকটা পাস করিয়েছেন, যদিও আজকের চাকরীর বাজারে এটুকু বিদ্যা ভীষণভাবেই অপ্রতুল - ভরসা সুপারিশ। অভিনব ও তার ছোট বোন মিঠুর করা কিছু টিউশান, আর মায়ের চার বাড়িতে ঠিকে কাজের লোকের রোজগারে কোনমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জীবন - থুড়ি, কালযাপন তাদের।

একশোটা টাকা বলে কথা! চাকরীটা তো নাও হতে পারে - তখন? সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্ত লাগাল অভিনব। বাসেই যাবে সে, কত আর দূরত্ব উল্টোডাঙ্গার বাগুইয়াটি থেকে? আগে থেকেই বুকপকেটে খুচরো পয়সায় বাসভাড়াটা বার করে রাখল সে। গল্প এগোবার আগে আমাদের অভিনব সম্বন্ধে কিছু কথা জেনে রাখা দরকার।

বাগুইয়াটির পিছনের বস্তিতে জন্ম ও বেড়ে উঠলেও অভিনব কিন্তু আপাতত সার্থকনামা। ভীষণই ভদ্র, সৎ, পরিশ্রমী, রুচিবান কিন্তু অন্তর্মুখী মানুষ সে। কোথা থেকে এ গুণ সে পেলো সেটা বিচারসাপেক্ষ, কিন্তু বস্তিতে সবাই তাকে সম্ভ্রমের চোখে দেখে। বইএর পোকা সে, দেশ বিদেশের অনেক খবরাখবর তার নখদর্পণে। ভীষণ চাপা স্বভাব তার, কখনও কারো কাছে সে কোন আবদার করেনি জীবনে!

তার এই স্বভাবটা জন্মগত, আর পরবর্তীকালে যখন সে মুন্সী প্রেমচাঁদের লেখা পড়ে, ‘ইদ্গাহ’ গল্পের সেই ছোট ছেলেটি যেন তার ভিতরে আরও ভীষণভাবে বেঁচে ওঠে। ট্রেনে ট্রেনে বাদাম, ডালমুট, ঝুরিভাজার সওদাগর বাবার কাছে মুখ ফুটে একখানা ঘুড়ি অব্দি কখনও চায়নি সে। বর্তমানে নিঃশব্দে তাদের টিউশানের পারিশ্রমিক ঢেলে ফাঁকফোকরগুলো ভরাট করতে চাইতো ভাই আর বোনে।

অভিনবের বাবা মানুষটা কিন্তু বস্তিতে জীবন শুরু করেননি। তাঁর বহুদিনের চাকরী ছিল একটি বেসরকারি অফিসে, যেখানে শেষে তালা ঝুলে যায় - পরিণতি হকারগিরি। ফলে ভাইবোনের মননশিলতার অভিনবত্ব  সহজেই অনুমেয়। তাদের ছোটবেলাটা তাও ভাল ছিল, অভাব অনটন আরও বেশী করে গলা টিপে ধরল যেদিন থেকে বাবা পা ফস্কে ট্রেন থেকে পড়ে গেলেন। একটা পা গোড়ালি থেকে কাটা গেল।

তারপর থেকেই ভাইবোনের নীরব লড়াই শুরু হল। ভোগবিলাসের যাবতীয় সামগ্রী, খাবারদাবার, পোশাক ইত্যাদির হাতছানি উপেক্ষা করতে পেরে তারা হয়ে উঠেছিল বস্তির গর্ব। অবিনবের ভিতর আরেকটি গর্ব ছিল - দারিদ্রের অহঙ্কার। মায়ের কাজের বাড়িগুলি থেকে পুরনো জামাকাপড় দিলে সে প্রবল আপত্তি করত। যা কিনতে পারবে তারা তাই পরবে, এমনকি বাবা মাকেও পুরনো কিছু পরতে দিতো না সে!

বস্তি যখন, কেবল টিভির পদার্পণ ঘটবেই। প্রচুর ঘরে অন্যায়ভাবে হুকিং করে টিভি চলে তাদের বস্তিতে। অনেকের মোবাইল ফোন হয়েছে। কিন্তু ভাইবোনের এসব ব্যাপারে কোন আগ্রহই নেই। বাবা দীর্ঘশ্বাস আর মা চোখের জল ফেলে ভাবেন, এই রকম লক্ষ্মী সন্তানদের জন্য কিছুই করতে পারলেন না ওঁরা, পড়াশোনার সুযোগ তো দূর অস্ত, দুবেলা একটু ভাল খাবারও দিতে পারেন না ওদের মুখে!

জোগাড় করে আনা বইপত্র, খবরকাগজ বা পত্রিকা, মোটকথা যা পাওয়া যায় তাতেই মুখ ডুবিয়ে থাকে অভিনব। ভাইবোনের মধ্যে মাঝেমাঝে হাসাহাসি ও খুনসুটি চলে মৃদু গুনগুণ শব্দে। মা সেদিন কাজের বাড়ি থেকে আনা একটা রংজ্বলা, ফুটো শাড়ি পরতেই অভিনব চুপ করে গেল। ইচ্ছের বাইরে কিছু হলে মুখে পড়ে কুলুপ, আর চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ে নিঃশব্দে অভিনবের, এই বয়সেও।

তাদের বস্তিতে কোন কুকুর, বেড়ালের ছানা ড্রেন বা ডোবার জলে পড়ে গেলেও প্রাণে বেঁচে যায়। গাছ থেকে পড়ে যাওয়া পাখির কচি ছানা, পা ভাঙ্গা ছাগলছানা ইত্যাদি কত পশুপাখি যে অবিনব আর তার দলবলের অবিশ্রান্ত শুশ্রূষায় ভালো হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এমনকি বেশ কিছু ভবঘুরে, পাগল, ভিখারি জানে যে এই রোগা ছেলেটা একবার খোঁজ পেলে তাদের অন্তত একটু খাবার আর নিঃশর্ত যত্ন জুটবে।

আরেকটা কাজ করে অভিনব নিঃশব্দে - প্রতি মাসে বস্তির প্রতিটি বাড়ির দুয়ারে একটি টিনের কৌটো নিয়ে দাঁড়ায়। পরিবারের লোক অনুযায়ী মাথাপিছু কুড়ি টাকা করে ওই টিনে ফেলে বস্তির মানুষ ছেলেটাকে  চোখ ভর্তি জল চেপে আশীর্বাদ করে। প্রত্যেকে জানে এইটুকু পুঁজি হল তাদের মতো গরীবদের মেডিক্লেম - এবং এর দরুন যৎসামান্য হলেও উপকৃত বস্তির মানুষ।

এটুকুই অভিনবের ক্ষমতা। প্রতিকূলতা, অভাব, অনটনের সাথে লড়েও সে সবার জন্য করার চেষ্টা করে। আরও প্রচুর কাজ করার ইচ্ছে তার - কিন্তু সাধ ও সাধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব। শুধু যদি একটা চাকরী পাওয়া তাহলে তাদের সংসার ছাড়াও বস্তির জন্য কিছু করার স্বপ্ন দেখে সে। কোথায় যেন পড়েছিল সে - মান আর হুঁশ মিলে মানুষ। বড়লোক হতে চায়না সে, শুধু একজন ভালো মানুষ হবে সে।

অভিনবের লক্ষ্য, সততার সাথে উপার্জন করে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবে সে। বস্তিতে থাকলেও তাসখেলা, মদ মাতালের আসর, মাইক চালিয়ে নাচগান, ঝগড়াঝাঁটি, মারপিট, আড্ডা ইত্যাদি কখনও তাকে ছুঁতে পারেনা। সে অন্যরকম - সে সত্যিই অভিনব। সেই ছেলে এখন বাগুইয়াটির মোড়ে দাঁড়িয়ে মরিয়া হয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে চায় সময়মত।

বাদুড়ঝোলা একটি বাস বেছে নিল অভিনব - মানে বাছতে হলনা আলাদা করে অবশ্যই! অনভ্যাসের ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুঁতির শেষে সে একেবারে তলার পাদানিতে কোনরকমে একটা পা রাখতে পারল, আর হাতে পেলো বাসের জানলার একটা ফ্রেম। কয়েক মুহূর্তেই ও বুঝতে পারল যে এভাবে তো পারবেনা, তার দুর্বল শরীর পেরে উঠবে না ঝুলে থাকতে, নেমে পড়তে চাইলো তৎক্ষণাৎ।

কিন্তু বাস ততক্ষণে গতি নিয়েছে। প্রাণ হাতে নিয়ে ঝুলে থাকল সে - আর তখনই বাসের ভিতর থেকে প্রবল কথা কাটাকাটির আওয়াজটা প্রথম কানে এলো তার! মন দিল না সে ওইদিকে - তার মনে এখন দুটি চিন্তা। আজ কি সফলতার মুখ দেখবে সে? পারবে কি তার পরিবারকে দিতে একটি সুস্থ, সচ্ছল, সুন্দর জীবনের উপহার? বাস্তবে ফিরল সে - তার হাত, কাঁধ ব্যাথায় টনটন করছে ইতিমধ্যেই!

বাসের প্রতিটি মানুষের কান যেন সেদিকে - বৈচিত্র্যহীন জীবনে কিছুটা হলেও যেন বিনোদনের অবকাশ! কি নিয়ে ঝামেলা তা বোঝা যাচ্ছেনা অবশ্য, তবে ঝামেলা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে যেন! কথাকাটাকাটি থেকে আস্তে আস্তে ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে। বাসের ভিতর তিলধারণের জায়গা না থাকায় ভীড়ের চাপটা দরজার দিকে ছড়াতে শুরু করল আর আতঙ্কে প্রমাদ গুনল দরজায় ঝুলন্ত অসহায় কিছু মানুষ!

চলুন দেখা যাক বাসের ভিতরে কি নিয়ে এতো গণ্ডগোল হচ্ছে! এয়ারপোর্টের কাছাকাছি থাকে রনি আর রব্বি, ছোটবেলার দুই বন্ধু। সাথে আছে সিম - রনির বোন। এদের বাবা মায়ের অনেক সাধ করে দেওয়া নাম হল যথাক্রমে রণজিৎ, রবীন্দ্র ও অসীমা। এদের বয়স মোটামুটি অভিনবের কাছাকাছি, পড়াশোনা নামকরা কনভেন্টে, আর প্রত্যেকে বেশ বড়লোকের বাড়ির সন্তান।

কাজেই এরা প্রাচুর্যের মধ্যেই বড় হয়েছে, সচ্ছলতা ও অতিরিক্ত পাওয়া এদের কাছে অভ্যেস ও অধিকার। এটুকু বয়সেই তারা নানারকম নেশায় সিদ্ধহস্ত। বাবা মায়ের হাতের বাইরে চলে গেছে তারা, তাই তাঁরাও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের আজকের প্রোগ্রাম হল - রনি তার বোনকে আইপড কিনে দেবে, তারপর তারা কোন রেস্তোরাতে খানাপিনা সেরে, ডিস্ক এ গিয়ে রাত করে বাড়ি ফিরবে।

সবার বাড়িতেই গাড়ী আছে, কিন্তু কেউই আজ ম্যানেজ করতে না পারায় মেজাজ ঠিক ছিলোনা। বাসে চাপাটা তাদের কাছে ভীষণই নিচুতলার কাজ মনে হয়। আজ গাড়ী না পেয়ে তারা ওলা বা উবের বুক করতে চেয়েছিল, কিন্তু অফিসটাইম, তাই কোনরকম ট্যাক্সিই পায়নি তারা। নতুন জিনিস কেনার তাড়না প্রবল মনে হওয়ায়, গজগজ করতে করতে বাসেই উঠে পড়েছিল তিনমূর্তি।

রব্বির কাছে রনি ছয় হাজার টাকা পেতো, আজ সেই টাকা ও বাকি টাকা এটিএম থেকে তুলে আইপড নেবার কথা। কিন্তু এটিএম থেকে রব্বি মাত্র তিন হাজার টাকা তুলেছে। বাকিটা পরে দেবে সে। তাহলে বাকি টাকার কি হবে - এই নিয়ে সুত্রপাত। শুধু একটা কথাই বেফাঁস বলেছিল রনি - ‘তুই জানিস যখন আজ আমাদের প্রোগ্রাম, কেন টাকাটা সময়ে তুললিনা? টাকাটা মেরে দিবি নাকি ?’

পাবলিক বাসে অচেনা লোকজনের সামনে এই অতর্কিত আক্রমণ রব্বির সহ্য হলনা। সেও চোখা চোখা বিশেষণে সাজিয়ে দিল তার উত্তর - যেটা ভাইবোনের একেবারেই ভালো লাগলো না। সেখান থেকে এক কথা হতে হতে, নানান সত্যি বেরিয়ে পড়তে শুরু করল। কথার পিঠে কথা উঠতে তারা নিজেদের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, এমনকি তাদের বাবা মায়েদের পেশা, নেশা ও চরিত্র নিয়ে টানাটানি করতে শুরু করল।

অশান্তিটা হয়তো আর বাড়ত না, হটাত করে তাদের বাবার রোজগার নিয়ে কি একটা আলপটকা  মন্তব্য করে বসল রব্বি সিমকে উদ্দেশ্য করে - ফলে সিম এক থাপ্পড় মেরে বসল তাকে। প্রতিহিংসায় রব্বি সিম কে মারতে উদ্দ্যত হতেই রনি আর রব্বিকে আটকানো গেল না আর, একটি ঘুষিতে রনির ঠোঁট ফেটে ঝুলে পড়লো। আর অল্প সময়েই তাদের এই অশান্তি ছড়িয়ে পড়লো বাসের অভ্যন্তরে।

এইটুকু ছেলেমেয়েদের ভিতর এতো রাগ, হতাশা, জিঘাংসা লুকিয়ে ছিল? এরা তো জীবনে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। লজ্জা লাগছে না তাদের? তারা ভালো বাড়ির ছেলেমেয়ে, ভালো ভালো স্কুলে পড়েছে প্রত্যেকে - সামান্য কটা টাকার বেহিসাবে তাদের ক্ষোভ, না পাওয়ার যন্ত্রণা, একে অপরের প্রতি নোংরা মনোভাব লুকিয়ে রাখা, সব বেরিয়ে আসতে লাগলো ভলকে ভলকে।

যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়তে চাইছে যেন কাঁধ থেকে হাতদুটো - তার জীবনে কক্ষনো সে এভাবে ঝুঁকি নেয়নি। আর কখনও সে এভাবে বাসে চাপবেনা - ভিতর থেকে অসহায়তা যেন ডুকরে কেঁদে উঠলো। কখন নামতে পারবে সে? আর যে পারছেনা অবিনব! বাস যে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো ছুটছে কোথাও না দাঁড়িয়ে - এই বাঙ্গুর ছাড়িয়ে গেল। ড্রাইভারের এই ট্রিপে আর প্যাসেঞ্জারের দরকার কি - তার বাস টইটম্বুর যে!!

ভিতরের ঝামেলাটা শেষ পর্যন্ত যেন হটাত বোমার মতো ফেটে পড়ল। ঠেলাঠেলি থেকে মারপিট শুরু হয়েছে, মহিলা ও শিশুদের চীৎকার, অশ্রাব্য গালিগালাজ আর বাস থামাবার জন্য চেঁচামেচি। কন্ডাক্টারের ‘রোককে! রোককে!’ আর বাস পেটানো সত্ত্বেও বাস একই গতি ধরে রেখেছে। দরজায় ঝোলা মানুষগুলো আতঙ্কে আর্তনাদ করলেও কারো ভ্রূক্ষেপ নেই, প্রানভয়ে প্রত্যেকে হতবাক। এই দুঃস্বপ্ন কখন শেষ হবে?

অভিনবর ইন্দ্রিয়গুলো আর কাজ করছে না, সর্বশক্তি দিয়ে আঁকড়ে থাকা হাতদুটো যেন অসাড়, আর ভিতরের অসীম ধাক্কাধাক্কির ফলে তার মতো পাদানিতে দাঁড়ানো কয়েকজনের নীচে পড়ে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। অভাব অনাহারক্লিষ্ট একুশ ছুঁই ছুঁই জীবনের কিছু ছবি তার চোখের সামনে দিয়ে দৌড়ে গেল - তার মন এখন কিছু ভাবছেনা, তার দৃষ্টি এখন মধ্যবর্তী।

একটা সুন্দর বারান্দায়, বাবাকে ফর্সা জামাকাপড়ে বসে কাগজ পড়তে দেখল অভিনব। পরক্ষনেই নীল দড়ির মতো পাকানো শিরা সম্বলিত মায়ের হাতদুটো আর মিঠুর মুখটা একবার ভেসে উঠতেই তার স্রান্ত হাতদুটো আলগা হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে লোপ পেয়ে গেল দৃশ্য, বর্ণ, গন্ধ, শব্দের যাবতীয় ঐকতান - সব ঢেকে গেল কালো পর্দায়।

ধূসর পিচরাস্তার উপর একটি নিঃস্পন্দ শরীর পড়ে - পোশাকি ভাষায় যার নাম ‘বডি’! মাথার উপর দিয়ে পিছনের চাকা চলে গেছে। রাস্তার ঢালু দিক বেয়ে সর্পিল ধারায় গরম রক্তের চুইয়ে পড়া। আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে কয়েকটি রক্তমাখা কয়েন। রোজকার মতো আরেকটি পথ দুর্ঘটনা। পুলিশ এসে যাবে এখুনি, বিক্ষোভ হবে, হয়তো অবরোধও। ক্ষিপ্ত জনতা হয়ত আগুন দেবে কোন বাসে - নিষ্ফল আক্রোশে!

অভিনবকে আর মায়ের অতি কষ্টের রোজগার একশো টাকাটার জন্যে ভাবতে হবেনা কোনদিনও! সে তার সামান্য পুঁজি রক্ষা করে মায়ের হাতে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল! ভাবতেও পারেনি অভিনব, সেটা করতে গিয়ে তাদের কঙ্কালসার সংসারের শেষ আশাটুকু, অযত্নে পালিত পুঁজিটুকুও বিনা দোষে, অনাদরে লাশকাটা ঘরে পৌঁছে যাবে এইভাবে!!

পরদিন দুর্ঘটনা কলামে দু কলমে লেখাটা বেরোতে অধিকাংশ ভদ্রসন্তান ভ্রু কুঁচকে ‘বস্তির জানোয়ারগুলো কলকাতাকে শেষ করে দিল - সারাক্ষণ বাসের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বদমায়েশি। যতসব সমাজবিরোধীর দল। বেশ হয়েছে, পৃথিবী থেকে অন্তত একটা অপদার্থ বাদ গেছে! এখন এর জন্যে এবার কোথায় আগুন জ্বলে কে জানে? বস্তির শহীদ বলে কথা!’, এই সারমর্মের চর্বিতচর্বণ করে বিনোদনের পাতা ওলটান।

দুর্ঘটনার পরের দিনই ভি আই পি রোড নতুন সাজে ঝকমক করছে - রাস্তার দু ধারে অগুন্তি মানুষ সবুজ মেরুন পতাকা নেড়ে শোরগোল করছে। যে সে ব্যাপার নাকি - আজ যে বিশ্ব ফুটবলের রাজপুত্র আসছেন কলকাতায়, সুদূর পর্তুগাল থেকে!!! জনতা ধন্যি ধন্যি করছে, ক্রীড়া মন্ত্রকের পক্ষ থেকে এ কি অভিনব প্রচেষ্টা শহরের মানুষের জন্যে!!!




#এই গল্পের চিন্তাধারা সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত। কোন জীবিত অথবা মৃত ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কোনরূপ কর্মকাণ্ডের সাথে যদি এই গল্পের কোন ঘটনার মিল থেকে থাকে, তা সম্পূর্ণ কাকতালীয় ও অনিচ্ছাকৃত।



।। সমাপ্ত ।।

| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
  | Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
|Special Puja Issue,2019 | September-October, 2019 |
| Third Year Third Issue |20Th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |















একটুকরো ভাবনা-সৌহার্দ্য -তৃপ্তি মিত্র


সৌহার্দ্য

তৃপ্তি মিত্র

Image Courtesy: Google Image Gallery

আমাদের অন্তরদর্শন বলে আমরা মনুষেরা ভীষণ স্বার্থপর ৷ আমরা কেবল নিজেকে নিয়েই মগ্ন ৷ অন্যের ভালো ,মন্দ নিয়ে খুব একটা চিন্তিত্ব নই ৷ বরং নিজের লাভ ও ক্ষতির হিসেব করি ৷ এই আত্মকেন্দ্রিকতা বর্জন করা উচিত ৷

আবার সঙ্ঘপ্রিয়তা মানুষের স্বভাবজাত ৷ কোন মানুষই একাকি থাকতে পারে না ৷ তেমনি মানসিক বৈচিত্রের অন্ত নেই৷ প্রতি  মানুষ প্রতি মানুষের থেকে আলাদা ৷ তার ইচ্ছা,রুচি,আদর্শ একজনের সঙ্গে আর এক জনের মেলে না ৷ দুজন ব্যাক্তি একই পথের পথিক নয় ৷ অর্থাৎ মানসিক বৈচিত্রের অন্ত নেই ৷ তবে এই বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য সঞ্চার করতে পারলেই বন্ধুত্ব ৷

বন্ধুত্বের সৌরভে মানুষের জীবন অনন্ত গুণ সুন্দর হয়ে ওঠে ৷ তবে এই বন্ধুত্ব একতরফা গড়ে ওঠে না ৷ যেখানে যথার্থ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সেখানে কোন ছল চাতুরী চলে না ৷ বন্ধুত্ব হল সুক্ষ কোমল একটি বস্তুর মতো যাকে অনান্য ভঙ্গুর বস্তুর মতো আগলে রাখতে হয় ৷ সুন্দর কথা, প্রাঞ্জল হাসি এবং আন্তরিক ব্যাবহারের অসম্ভব ক্ষমতা ৷  বিশ্বস্ততা ও সততা ছাড়া ও বন্ধুত্ব হয় না ৷ বন্ধুত্বে ভালোবাসার পাশাপাশি আন্তরিক হওয়াটাও জরুরি ৷ প্রকৃত বন্ধুত্ব সেখানেই অটুট থাকে যেখানে কোনরকম ছল চাতুরীর স্থান নেই ৷ বন্ধু নির্বাচন করতে হবে তাদের মস্তিস্ক ও চরিত্র বিচার করে ৷ তুমি নিজেই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারো তেমন একজন বন্ধু হতে ৷


।। সমাপ্ত ।।

| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
  | Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
|Special Puja Issue,2019 | September-October, 2019 |
| Third Year Third Issue |20Th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |




















কবিতা-কালো মাটির- মেয়ে সম্পা পাল


কালো মাটির মেয়ে

সম্পা পাল

 
Image Courtesy: Google Image Gallery

ক্ষুধিত জীবন , প্রগাঢ় উদাহরণ
তবু কিছু অনুভব উঠে আসে

এক হৃদয় আর এক হৃদয়ে ধাক্কা খায়
অক্ষর শেখা বিকেল ঘুরে এসে কাছে বসে
পুজোর ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া ডেমিন এখনও সেদিনের মতো করেই ঠিকানা খোঁজে ।

কিছু শব্দ ঠোঁটের কাছে এসে
জানতে চায় - জীবন ভালো আছে তো !

টেথিসের গভীরে হৃদয়ের  অকথিত কম্পন
তারপরও জন্ম নেয় এক কালো মাটির মেয়ে.....



।। সমাপ্ত ।।

| Aleekpatamagazine.blogspot.in |
  | Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
|ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
|Special Puja Issue,2019 | September-October, 2019 |
| Third Year Third Issue |20Th Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |



















Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান