কালাপানির দেশ আন্দামান (পর্ব- ২)
তৃপ্তি মিত্র
সংখ্যা -২৩, (২৬ ই জুলাই , ২০১৮) |
গন্তব্যস্থল " রস আইল্যান্ড "
পোর্টব্লেয়ারের আগে এখানেই ছিল ব্রিটিশদের রাজধানী ৷ ১৮৫৮ - ১৯৪১ পর্যন্ত " রসআইল্যান্ড ছিল ব্রিটিশদের অধীনে ৷ তারপর জাপানিরা এর দখল নেয় ৷ এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে প্রচীন কিছু ধ্বংসাবশেষ ৷ সেই সময়কার কিছু প্রাচীন ঝুরঝুরে ভেঙ্গে পড়া বাংলো , চুরমার চার্চ , আগাছায় ঢেকে যাওয়া সমাধি ৷ চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে অতীতকে হাতড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম ৷ একসময় এই চার্চেই বাজত পিয়ানো , অর্গানের সুর , চার্চের ঘন্টা ৷ কি অদ্ভুত এখন সেই পরিত্যক্ত দ্বীপে রাস্তা আছে মানুষ নেই ৷ আর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দৈত্যকার কিছু গাছ , আগাছা আর সারিবদ্ধ নারকেল গাছের দীর্ঘশ্বাস ৷ পুরনো ইতিহাসকে খৌঁজার চেষ্টা করলাম ৷ একজায়গায় এসে পেলাও বোধহয়- সেই সময়কার বিমান ধ্বংসকারী কামান ৷ আর সমুদ্রের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে লাইটহাউস ৷ মাঝে মাঝে আন্দামানের উজ্জল আকাশের রোদে ঝলসে যাবার উপক্রম ৷ তখন দৈত্যের মত বিশাল বিশাল গাছের নিচে শান্তির আশ্রয় ৷ আর শৌখীন নেশা ধরা সমুদ্র বাতাস তো আছেই আর সে সঙ্গে গলা ভেজাতে ডাবের জল ৷ কয়েকটি হরিণ , ময়ূর , খরগোষ চোখে পড়ল ৷ আরো একটু ভিতরে যেতে নজর পড়ল পোড়ো ভাঙ্গাচোরা ঘর বাড়ি আগাছায় ঢেকে আছে , ভিতরে ঢুকতে সাহস হল না শুনেছি আন্দামানের সবুজ সাপের ছোবল নাকি সাংঘাতিক ৷ এর একটি ছোবল শরীর অবশ করে দিতে পারে নিমেষের মধ্যে ৷ দশ থেকে বারো ইঞ্চি তেঁতুল বিছে , কাঁকড়া বিছে ৷ যাইহোক, তাদের কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো না বরং প্রচুর হরিণ আর ময়ূরের সঙ্গে দেখা হল ৷ ওরা মানুষের সঙ্গেই হেঁটে চলে বেড়াছে ৷ বেশ কয়েক ঘন্টা এখানে ছিলাম ৷ সুনামির প্রভাবে বেশ কিছু ক্ষয় ক্ষতি চোখে পড়ল ৷ বর্তমানে এই আইল্যান্ডের নামকরন হয়েছে " লক্ষীবাই আইল্যান্ড " ৷ এখান থেকে চলে গেলাম " নর্থ বে আইল্যান্ড " ৷ যেখানে গ্লাসবোট চড়ে দেখলাম সাগরতলের প্রবাল ও রংবেরং এর মাছ ৷ সারাদিন পর ফিরে এলাম পোর্টব্লেয়ারের আস্তানায়, " নাগরিণ টুরিষ্ট লজ " ৷ নাগরিণ বেশ ছিমছাম ঘরোয়া ৷ নাগরিণের মালিক জেমস জয় এর সুযোগ্য পুত্র সুরজই সব দায়িত্ব সামলাচ্ছে ৷ এখানের সমস্ত কর্মী মহিলা ৷ প্রত্যেকের সঙ্গে কম বেশী ভাব জমিয়ে তুলেছি ৷ একজন এসে আলাপ করে গেলেন , বললেন কোলকাতায় থাকেন ৷ কোথায় থাকেন জানতে চাইলে বললেনং বঁনগায় ৷ মনে মনে একটু হাসলাম ৷ একদল টুরিস্টের সঙ্গে আলাপ হল ৷ কোথা থেকে এসেছেন জানতে চাইলে বললেন কোলকাতা থেকে এসেছেন ৷ কোলকাতার কোথায় জানতে চাইলে বললেন " মেদিনীপুর " আবার ও হাসলাম ৷ এরপর থেকে কারো সঙ্গে আলাপ হলে ভয়ে জানতে চাইতাম না কোথায় থাকেন বা কোথা থেকে এসেছেন ৷ আমাদের পরবর্তী গন্তব্য নির্দিষ্ট হল বারাটাং ৷ যথারিতী আমাদের গাইড কাম ড্রাইভার ভাইয়া ( সুভ্রমন্নিয়ম ) হাজির ৷ খুবই ভালো ছেলে মাদ্রাজি ৷ বাংলা খুব একটা বোঝে না ৷ হিন্দীটা ভালো বলে ৷ আমি ওকে ভাইয়া বলে ডাকতাম ও আমাকে ম্যাডাম ৷ ভাইয়ার নির্দেশ মত রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ রওনা দিলাম , যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম "ঝিরকাটাং " চেক পোষ্ট " ৷ মিডল ষ্ট্রেট জেটি ঘাট পর্যন্ত ৪৮ কি.মি রাস্তা জারোয়া রিজার্ভ ফরেষ্ট ৷ এইপথ টুকু সরাসরি পুলিশি প্রহরায় গাড়ীর কনভয় ছুটল ৷ মনে খুব উৎসাহ কখন জারোয়াদের দেখতে পাবো ৷ চালক ভাইয়ার কড়া নির্দেশ কেউ গাড়ী থেকে মুখ বার করবেন না ৷ কোন রকম খাবার দেওয়া চলবে না ৷ ছবি তোলা চলবে না ইত্যাদি ইত্যাদি ৷ গাড়ী খুব হালকা গতিতে চলছিলো ৷ আর সতর্ক দৃষ্টি খুঁজে চলেছে জারোয়াদের ৷ কিছুক্ষন পর সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটল ৷ একটি ট্রাক ভর্তি এক দঙ্গল জারোয়াদের নিয়ে আমাদের সামনে হাজির ৷ অল্প বিস্তর পোষাক পরা সবাই ৷ আমাদের সঙ্গে হাসি বিনিময় হল ৷ একজন তো হিন্দিতে বললো কোথায় যাচ্ছো ৷ আমরা হাত নেড়ে টাটা কারলাম ৷ ওরাও টাটা করে বিদায় নিল ৷ আমরা যাদের কে দেখলাম আন্দামান সরকারই টুরিষ্টদের দেখানোর জন্য জারোয়াদের এভাবে নিয়ে আসে ৷ তবে কিছু উগ্র জারোয়া আছে তারা সচারাচর মনুষ্য সমাজে মেশে না ৷ ওরা আরো গভীর জঙ্গলে থাকে ৷ তবে ভাগ্য ভালো থাকলে দর্শন হয়ে যেতে ও পারে ৷ যাইহোক আমরা যে জারোয়াদের দেখলাম তাতেই আপাতত সন্তুষ্ট থাকলাম ৷
----- চলবে