বড় গল্প
অচেনা
অভিষেক দত্ত
“সে কি গো!”
“যেদিকে যাচ্ছে
তাতে যে কোন মোমেন্টে মাল্টি অর্গ্যান ফেলিওর...এক যদি না কোন মির্যাকল...”
“আহারে, ইশ...”
মালবিকা চুপ করে রইলো। একই
নার্সিং হোমের ডাক্তার হওয়ার সূত্রেই স্বামীর সহকর্মী ডক্টর মজুমদারের সাথে পরিচয়।
ডক্টর অনিকেত মজুমদার, নামকরা
কার্ডিয়াক স্পেশালিস্ট, অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতেই কম করে তিনমাস
সময় লেগে যায়। স্ত্রী
মধুমিতা,
ফিলজফির প্রফেসর।
এতো বড়ো নামকরা ডাক্তার হয়েও ডক্টর
মজুমদার অমায়িক এক মানুষ। যেমন
সুন্দর চেহারা তেমন অপূর্ব ব্যবহার। স্ত্রী মধুমিতাও সেই রকম আলাপী আর মিশুকে। শিক্ষিত, ভদ্র, মার্জিত
এক দম্পতি।
অমন বাবা মায়ের উপযুক্ত সন্তান
অর্কপ্রভ। অসম্ভব
ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। মাধ্যমিক
উচ্চ মাধ্যমিক,
দুটো পরীক্ষাতেই প্রথম পাঁচজনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। তারপর আর পাঁচটা
ছেলের মতো জয়েন্ট আই.আই.টি.র গড্ডালিকা স্রোতে গা না ভাসিয়ে ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে ভর্তি
হয়েছে প্রেসিডেন্সি কলেজ।
আর পড়াশোনার বাইরে তার একটাই ধ্যানজ্ঞান
- মাউন্টেনিয়ারিং। বাবার
কাছ থেকেই নেশাটা পেয়েছে।
কিছু বছর আগে পর্যন্ত অনিকেত সময়
পেলেই ঘুরে বেড়াতেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন পাহাড়ে। এমনকি বিদেশে
ডাক্তারী পড়ার সময়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এহেন বাবার ছেলে বলেই বোধহয় পাহাড় অর্ককে চুম্বকের
মতো আকর্ষণ করে - এই বয়েসেই পর্বাতরোহণের ওপরে বেশ কয়েকটা কোর্স করে ফেলেছে। সুযোগ
পেলেই ছুটে যায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন পাহাড়ে।
আর এ শখে একমাত্র বাধা অর্কর মা।
অতিকষ্টে স্বামীর পাহাড়ের নেশা
ছাড়িয়ে একটু নিশ্চিন্ত হয়েছিল মধুমিতা। কিন্তু ছেলের কাঁধে ভর করে সে সর্বনাশা নেশা আবার
ফিরে এসেছে। তার
সঙ্গে যোগ হয়েছে বাবার অবাধ প্রশ্রয়। যদিও মধুমিতাকে বাবা ছেলে যথেষ্টই ভয় করে, কিন্তু
অর্ক যখন অবোধ শিশুর মতো ঠোঁট ফুলিয়ে আবদার ধরে আর অনিকেতও ছেলেকে ছাড়ার জন্যে অনুরোধ
করতে থাকে তখন বাধ্য হয়েই নিমরাজি হতে হয়।
যেমন এবারেও হতে হয়েছিল - অর্কর
বায়না আর অনিকেতের উপরোধে। তবে ভরসা একটাই হিমালয়ের মতো বিপজ্জনক জায়গা নয়, অর্করা
এবারে দল বেঁধে যাচ্ছে উড়িষ্যার মহেন্দ্রগিরিতে। আর খুব বেশিদিনের
জন্যেও নয়,
সাতদিন থেকেই ফিরে আসবে।
পাহাড়ে যাওয়ার কথা উঠলেই অনিকেত
যেন ফেলে আসা যৌবনের দিনগুলোয় ফিরে যায়। অতিব্যস্ত ডক্টর মজুমদার তখন সব ফেলে অর্কর সঙ্গে
আসন্ন অভিযানের আলোচনায় মশগুল হয়ে ওঠে। বাবা ছেলের কান্ড দেখে না হেসে থাকতে পারেনা মধুমিতা। নেহাত
কঠিন বারণ আছে তাই, নইলে বোধহয় ছেলের দলে জুটে গিয়ে বেরিয়ে পড়তো। মানুষটাকে
দেখে তখন কে বলবে যে এই সেই রাশভারী ডাক্তার, যার ভয়ে রোগী
থেকে আরম্ভ করে সহকারীরা পর্যন্ত তটস্থ হয়ে থেকে।
এবারেও সেই রকম মেতে উঠেছিল অনিকেত। সারাদিন
পাহাড় নিয়ে আলোচনা করেছে, নিজের যৌবন বয়সের অভিযানের কথা সাড়ম্বরে
শুনিয়েছে,
এমনকি যে জায়গায় যায়নি তার গল্পও বাদ থাকেনি।
আর বাবার বলা গালগল্প ধরে ফেলে
যথারীতি খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসেছে অর্ক।
রাত্রে খাওয়ার পরে মেঝেতে ম্যাপ
বিছিয়ে সম্ভাব্য রুট নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে দুজনের আলোচনা চলেছে, অবশেষে
মধুমিতার কড়া গলায়, “কি ব্যাপারটা কি তোমাদের”, শুনে বাবা ছেলে
সুড়সুড় করে যে যার মতো শুতে গেছে।
অবশেষে অর্কদের যাওয়ার দিন এসে
পড়ল। প্রতিবারের
মতো অনিকেত নিজে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে এলো ছেলেকে। আর মনের মধ্যে
কাঁটার মতো ফুঁটতে থাকা অস্বস্তিটাকে নিয়ে সাতটা দিন কাটালো মধুমিতা।
সাতদিন পরে যথারীতি ফিরে এলো অর্করা। স্টেশন
থেকে ড্রাইভ করে বাড়িতে নিয়ে এলো অনিকেত।
ছেলেকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো
মধুমিতা। যথারীতি
অনিকেত অনর্গল প্রশ্ন করে চলেছে মহেন্দ্রগিরি নিয়ে। নিয়ে। যৌবনকালে
দেখা পাহাড়টাকে ছেলের চোখ দিয়ে নতুন করে দেখতে চাইছে।
তখনই একটু খটকা লেগেছিল মধুমিতার। কই অন্যবারের
মতো বাবার সঙ্গে সমান তালে গল্প করছে না, ছেলে না বাবা কে কত কম সময়ে পাহাড়চূড়ায়
পৌঁছে যেতে পেরেছে তা নিয়ে দুজনের মধ্যে তুমুল তর্ক হচ্ছে না, বাবার
কথায় হুঁ হাঁ করে কেমন যেন দায়সারা উত্তর দিয়ে চলেছে।
কোনবার তো এ’রকম করে না !
“অ্যাই, কী হয়েছে
রে তোর, এরকম
ঝিমিয়ে আছিস কেন!”
“কই কিছু না তো,” প্রশ্নের
উত্তরে জোর করে হেসে জবাব দিলো।
“তাহলে এ'রকম
চুপচাপ আছিস যে!”
“অনেকক্ষণ ট্রেন
জার্নি করে এসেছে তো,” ছেলের হয়ে অনিকেতই উত্তর দিলো, “তাই বোধহয় টায়ার্ড। এনিওয়ে, ভালো
করে রেস্ট নে,
তাহলেই ঠিক হয়ে যাবি!
তখনকার মতো চুপ করলেও মধুমিতার
মা’য়ের মন মানতে চায়নি। ঘন্টাখানেক
বাদে, অর্ক
যখন ঘুমোচ্ছে,
তখন কপালে হাত রেখে চমকে উঠলো, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
“সে কি,” অনিকেতও
অবাক, “চলো
তো দেখি!”
ছেলের গায়ে হাত দিয়ে অনিকেতের
কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়লো।
“কিগো, ভয়ের
কিছু নেই তো,”
মধুমিতা উদ্বেগ ভরা গলায় জানতে চাইলো।
ততক্ষণে অর্কর ঘুম ভেঙে গেছে।
“কদ্দিন ধরে জ্বর
হচ্ছে,” ছেলের
দিকে তাকিয়ে ডাক্তারি গলায় প্রশ্ন করলো।
“দু’তিনদিন থেকে, ওখানকার
দোকান থেকে ওষুধ কিনে খেয়েছি।”
“কেন, মেডিসিন
কিটে তো প্যারাসিটামল ছিল!”
“নামার সময়ে ব্যাগটা
হারিয়ে ফেলেছিলাম!”
“হুঁ, কী ওষুধ
দেখি...”
স্ট্রিপটা দেখেই বুঝতে পারলো দেহাতি
অঞ্চলে বহুল ব্যবহৃত সস্তা দরের ওষুধ যাতে কাজের থেকে অকাজ বেশি হয়। মনে
মনে বিরক্ত হলেও মুখে কিছু না বলে দামি প্যারাসিটামল নিয়ে এলো।
“একগ্লাস গরম
দুধের সঙ্গে খাইয়ে দাও,” ওষুধটা মধুমিতাকে দিলো, “আর কালকে
একবার ব্লাড টেস্ট করিয়ে নিতে হবে। “
“কি গো, কিছু
সাসপেক্ট করছো নাকি?”
“আরে না না, নেহাত
রুটিন এক্সামিনেশন।”
যদিও নিজে ভয় পেয়েছে, কিন্তু
মধুমিতাকে উদ্বিগ্ন করতে চায় না।
পরেরদিন সকালবেলায় অর্ককে দেখে
কিছুটা নিশ্চিন্ত হল। জ্বর
ছেড়ে গিয়ে বেশ ঝরঝরে লাগছে, বিছানায় আধশোওয়া হয়ে মা’র সঙ্গে গল্প
জুড়েছে। বাবাকে
দেখেই অভ্যাস মতো ঘাটশিলার কথা বলতে যাচ্ছিল, অনিকেতই বাধা
দিয়ে ছেলের নাড়িটা একবার দেখল।
নাঃ, সব ঠিক আছে, ভয়ের
কিছু নেই।
“শোন, আমি
এখন বেরোচ্ছি,”
ব্যস্ত ভঙ্গীতে মধুমিতাকে বলল, “একটু পরেই ল্যাব থেকে এসে স্যাম্পল নিয়ে
যাবে, আর দুপুরের
খাওয়ার পর আরেকটা ওষুধ খাইয়ে দিও।”
“রিল্যাক্স ম্যান, রাত্রে
এসে তোদের ট্রেকিংয়ের গল্প শুনবো,” হাসিমুখে ছেলের দিকে তাকালো, “সারাদিন
রেস্ট নিয়ে একেবারে ফিট হয়ে যা!
সারাদিন ধরে রোগী সামলাতে সামলাতে
ছেলের কথা প্রায় ভুলেই গেছিল অনিকেত। সন্ধ্যে নাগাদ সবে নিজের চেম্বারে এসে বসেছে এমন সময়ে
ফোনটা এলো।
“ডক্টর মজুমদার,” মোবাইলের
ও প্রান্ত থেকে ল্যাবের সিনিয়র প্যাথলজিস্টের উদ্বিগ্ন গলা, “শুনুন
আপনার ছেলের ব্লাড স্যাম্পেলে আননোন এলিমেন্ট পাচ্ছি।”
“আননোন এলিমেন্ট
বলতে...”
“ডিটেল কালচার
না করা পর্যন্ত কনফার্ম করতে পারছি না, তবে,” একটু ইতস্তত
করলেন, “গতবছর
এ ধরণের দুটো স্যাম্পেল এসেছিল, আনফর্চুনেটলি দুটো কেসই ফ্যাটাল হয়ে গেছিল।”
কপালটা ধরে চুপ করে বসে রইল অনিকেত, মনে
হচ্ছে অর্ককে হস্পিটালাইজড করা প্রয়োজন।
কিন্তু মধুমিতাকে কী বলবে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই মোবাইলটা
বেজে উঠলো,
ও প্রান্তে মধুমিতা।
“অর্কর আবার সাংঘাতিক
জ্বর এসেছে,
একশো চারের কাছাকাছি! তার সাথে কনভালশনস, খুব ভয় করছে
গো !”
“এক্ষুনি আসছি...”
নিজের গাড়িতে করেই অর্ককে নার্সিংহোমে
এনে ভর্তি করে দিল। তৎক্ষণাৎ
সমস্তরকম পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যবস্থাও হল।
কিন্তু সে সব রিপোর্ট দেখে আঁতকে
উঠলো অনিকেত - জীবনের লক্ষ্মণ দেখানো সবকটা প্যারামিটারই বিপজ্জনকভাবে নীচের দিকে নেমে
গেছে। আর একটু
এদিক ওদিক হলেই কোমায় চলে যাবে!
অন্যান্য ডাক্তারদের সঙ্গে সারারাত
পাগলের মতো ছেলের চিকিৎসা করে চলল। কিন্তু অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটলো না। এই মনে
হচ্ছে চিকিৎসায় বোধহয় সাড়া দিচ্ছে তো পরমুহূর্তেই অবস্থার অবনতি ঘটছে।
পরেরদিন সকালবেলাই যোগাযোগ করলো
বন্ধু ডাক্তারদেরকে। প্রত্যেকে
এসে দেখলো,
কিন্তু কোন আশাভরসা দিতে পারলো না। একটা বিষয়ে সবাই একমত, কোন পাহাড়ী পোকার
কামড়েই অর্কর রক্তে এই অজানা বিষ ঢুকেছে। আর বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক
না পড়ায় সে বিষ ঝড়ের মতো সাড়া শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে।
শেষ ভরসা হিসাবে সন্ধ্যেবেলায়
এলেন অনিকেতের বন্ধু, ট্রপিকাল ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় প্রধান, ডক্টর
ভৌমিক। অর্ককে
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার পরে ওনার মুখও গম্ভীর হয়ে গেল।
ততক্ষনে অনিকেত বুঝে গেছে একমাত্র
কোন অলৌকিক ঘটনাই অর্ককে ফিরিয়ে আনতে পারবে।
আর তা না হলে...
নাঃ, আর ভাবতে পারছে
না অনিকেত। নিজের
থেকেও বেশি করে মনে হচ্ছে মধুমিতার কথা। কাল থেকে শূন্য দৃষ্টি মেলে আই.সি.ইউ.র বাইরে ঠায়
বসে রয়েছে। একটা
কিছু দাঁতে কাটেনি। খাওয়ানো
দূরে থাক,
চেয়ার থেকে নড়ানো যায়নি।
এখন অর্কর যদি কিছু ঘটে যায়, মধুমিতা
কি করে সামলাবে নিজেকে।
অনিকেতের অভিজ্ঞতা বলছে চিরস্থায়ী
মনোরোগী হয়ে যাবে মধুমিতা।
কিন্তু সেসব তো পরের কথা, এখন
অর্ককে কি করে ফিরিয়ে আনবে মৃত্যুর মুখ থেকে!
বোবা দৃষ্টি মেলে করিডোরের দিকে
তাকিয়েছিল,
এমন সময়ে পরিচিত চেহারাটা দেখে চমকে উঠলো।
সাদা শার্ট, কালো
প্যান্ট,
ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো চুল, লম্বা ঋজু চেহারা, শক্ত
করে মুঠোয় ধরা স্টেথেস্কোপ। শান্তভাবে করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছে।
“তুমি এখানে?”
“হ্যাঁ এলাম, যে জন্যে
পেশেন্টের কাছে ডাক্তার আসে!”
“আমার ছেলে তোমার
পেশেন্ট?
কিন্তু তোমাকে ডাকা হয়েছে বলে তো জানিনা!”
“প্লিজ অনিকেত, এখন
তর্কের সময় নয়! আর শত্রুতা যদি থেকে থাকে তবে সেটা তোমার সঙ্গে, তোমার
ছেলের সঙ্গে তো নয়!”
“সরে যাও,” হঠাৎ
মধুমিতা বিকৃত গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, “ভেতরে আসতে দাও ওনাকে!”
“প্লিজ দীপঙ্কর,” করুণ
মিনতির সুরে অনুরোধ করলো, “একবার দেখে যাও অর্ককে!”
কোন কথা না বলে আই.সি.ইউ.তে ঢুকলেন
ডক্টর দীপঙ্কর বসু। মন দিয়ে
রিপোর্টগুলো দেখার পর নিজের হাতে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। তারপর চিরকুটে
কিছু একটা লিখে সঙ্গে থাকা ডাক্তারবাবুকে দিলেন।
হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন ডাক্তারবাবুটি। মিনিট
পাঁচেকের মধ্যেই প্রয়োজনীয় জিনিসটা নিয়ে ফিরে এলেন ।
দক্ষ হাতে অ্যাম্পুল থেকে তরলটা
বার করে নিয়ে অত্যন্ত সাবধানে ইঞ্জেক্ট করলেন।
তারপর একটা চেয়ারে বসে একদৃষ্টিতে
তাকিয়ে রইলেন অর্কর বেডের সঙ্গে লাগানো মনিটরগুলোর দিকে।
আর আই.সি.ইউ.র বাইরে একটা চেয়ারে
বসে রইল অনিকেত। কাঁচের
জানলা দিয়ে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে, সেখানকার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে
নিয়েছেন দীপঙ্কর। একদৃষ্টিতে
তাকিয়ে রয়েছেন মনিটরগুলোর দিকে, মাঝেমাঝে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন সঙ্গে
থাকা ডাক্তারবাবুদেরকে। নার্সরা
নিখুঁতভাবে কর্তব্য পালন করে চলেছেন।
ক্লান্তি আর অসহ্য উদ্বেগ - কখন
যে চোখদুটো বুজে এসেছে সেটা অনিকেত নিজেও বুঝতে পারেনি।
ঘুমটা ভাঙতেই চমকে উঠলো, সকাল
ছটা পনেরো। আই.সি.ইউ.তে
ঢুকেই মনিটরগুলোর দিকে তাকালো।
আশ্চর্য, গতকাল
সন্ধ্যের যা পরিস্থিতি ছিল তাতে তো এতোক্ষণে কিছু একটা ঘটে যাওয়ার কথা।
বাট অর্ক ইজ স্টিল ব্রিদিং!
মনিটরের রিডিংগুলোর কয়েকটা একই
জায়গায় আছে বাকিগুলো অতি সামান্য উন্নতির দিকে এগিয়েছে।
একদৃষ্টে মনিটরগুলোর তাকিয়ে আছেন
দীপঙ্কর,
মাঝে মাঝে সহকারীদের সঙ্গে চাপা গলায় দু’একটা বাক্য বিনিময় করছেন। অনিকেতের
দিকে ভ্রূক্ষেপও করলেন না।
সকাল ন’টা, ইতিমধ্যেই
দ্বিতীয়দফার ইঞ্জেকশন দিয়েছেন দীপঙ্কর। অবস্থা অতিখারাপ থেকে খারাপের দিকে এসেছে।
এ.সি.তে বসেও অনিকেতের কপালে বিন্দু
বিন্দু ঘাম জমছে। দীপঙ্করের
হাতেই কি শেষ পর্যন্ত সেই মির্যাকল ঘটবে, অর্ক ফিরে আসবে
তাদের কাছে!
দুপুর দুটো, অবস্থা
এখন আগের থেকে অনেকটাই ভালো - ওষুধগুলোতে সাড়া দিচ্ছে অর্ক। ব্লাড রিপোর্টটা
পেলে অবশ্য পুরোপুরি নিঃসন্দেহে হওয়া যাবে। তবে অনিকেতের অভিজ্ঞতা বলছে এরকম অবস্থা যদি চলতে
থাকে তাহলে হয়তো রাত্রির দিকেই বিপন্মুক্ত হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যেই অনিকেতের বন্ধু চিকিৎসকরা
এসে অর্ককে দেখে গেছেন। তাঁদের
একটা কথাও কানে ঢোকেনি। শুধু
‘সুপার্ব’,
‘ব্রিলিয়ান্ট’, ‘আনবিলিভেবল’, ‘মির্যাকলে’র মতো টুকরো টুকরো মন্তব্যগুলো
মাথার মধ্যে গেঁথে আছে।
“স্যার,” নার্সিংহোম
ম্যানেজারের কথায় সম্বিৎ ফিরলো, “ডাক্তার বসু কিন্তু কাল থেকে কিছুই খাননি, অফার
করলে রিফিউজ করছেন।”
“চলুন দেখছি...”
সাবধানে আই.সি.ইউ.তে ঢুকলো অনিকেত।
যথারীতি মনিটরগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে
তাকিয়ে রয়েছেন দীপঙ্কর।
“কাল থেকে কিচ্ছু
খাওনি,” কাঁধে
হাত রাখলো অনিকেত, “প্লিজ, অন্তত একটু স্যান্ডউইচ...”
“নট নাউ ডক্টর
মজুমদার,”
নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে উত্তর এলো, “নট নাউ।”
“দীপঙ্কর, প্লিজ!”
“উড য়ু বি কাইন্ড
এনাফ টু এক্সকিউজ মি!”
হাসিমুখে বলা কঠিন মন্তব্যটা শুনে
বুঝতে পারলো প্রাক্তন সহপাঠী দীপঙ্কর নয়, এটা ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসকের নির্দেশ।
মাথা নীচু করে বেরিয়ে এলো।
সন্ধ্যে পৌনে সাতটা। একটু
আগেই চোখদুটো অল্প খুলেছে অর্ক, ডানহাতটা তোলার চেষ্টা করেছে। ডাক্তারবাবু
আর নার্সদের মুখের হাসি ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। মৃত্যুকে অনেকটাই ব্যাকফুটে পাঠিয়ে দিতে পারা গেছে। এভাবে
আর চব্বিশ ঘন্টা কাটাতে পারলেই অর্ক পুরোপুরিভাবে চিকিৎসকদের আওতায় চলে আসবে।
মধুমিতাকে একবার দূর থেকে দেখতে
দেওয়া হল। ছেলেকে
দেখে অবশেষে চোখে জল এলো। প্রাণভরে
কেঁদে কিছুটা হালকা হলো।
গতকাল থেকে একটানা বসে আছেন দীপঙ্কর, শুধুমাত্র
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া ছাড়া আই.সি.ইউ.র বাইরে পা রাখেননি।
“সিস্টার, লেটেস্ট
রিপোর্টগুলো দেবেন।”
ফাইলটা হাতে তুলে দিলেন হেড নার্স। দ্রুতগতিতে
কয়েকটা নির্দিষ্ট পাতায় চোখ বুলিয়ে ফেরত দিলেন।
ভাগ্যিস গত মাসের মেডিকেল জার্নালে
ছোট করে ছাপা ট্রপিকাল রোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর ডুফেনহার্ডের লেখাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছিলেন।
নাহলে এতক্ষণে...
নাঃ, আর কিছুই ভাবতে
পারছেন না,
বারেবারে মধুমিতার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে!
টানটান হয়ে থাকা স্নায়ুমন্ডলীও
যেন এবারে একটু বিশ্রাম চাইছে। একটা সিগারেটের খুব প্রয়োজন। পায়ে পায়ে আই.সি.ইউ.
থেকে বেরিয়ে এলেন। ওয়াশরুমে
ঢুকে সিগারেট ধরিয়ে আয়নার দিকে তাকালেন।
ওখানে কার প্রতিবিম্ব, ডক্টর
দীপঙ্কর বসু,
না না ও তো দীপু!
পিকনিকের জমাটি হুল্লোড়ের মধ্যে
মধুমিতার গলা শোনা যাচ্ছে, “দীপু, অনিটা আবার পাগলামি
করছে, ধরে
আন তো!”
“ভীতুর ডিমদুটো,” নদীর
হাঁটুজলে দাঁড়ানো অনিকেতের হাসি শোনা যাচ্ছে, “ওখানেই বসে থাক!”
মাধ্যমিকের পর প্রেসিডেন্সিতে
ভর্তি হওয়ার কদিনের মধ্যেই তো তিনজন অভিন্নহৃদয় বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। আমি
আর অনি সায়েন্স,
তুমি আর্টস।
এই তো সেদিন, সেই
কলেজ লাইফ,
অনির গান,
তোমার কবিতা পাঠ, আমার চুপ করে থাকা!
প্রথমদিন থেকেই পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম, শুধু
বলে উঠতে পারিনি।
চিরটাকাল চুপ করে রইলাম বলেই তো
আমার ভালোবাসার কথাটা কোনদিন বুঝতে পারলে না!
তোমার জন্মদিনে অনেক কষ্টে একগোছা
লালগোলাপ জোগাড় করে দেখা করতে গিয়ে দেখলাম অনি বিশাল ফুলের বোকে আর উপহার দিয়ে ভরিয়ে
দিয়েছে।
আর দুহাতে সেসব সামলাতে সামলাতে
সলজ্জ হাসি হেসে বলেছিলে, “দেখেছো অনির খ্যাপামি!”
তুমি তো জানতে মধুমিতা আমার বাবা
লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক, অনিকেতের বাবার মতো নামকরা ডাক্তার নন। নিজের খরচ চালানোর
জন্যে পড়াশোনার সাথে সাথে টিউশনিও করতে হত। একগোছা লাল গোলাপ ছাড়া আর কিছুই জোগাড় করে উঠতে পারিনি।
কিন্তু অনির দেওয়া উপহার দেখে
লজ্জায় মাটিতে মিশে গেছিলাম বলে সে গোলাপও আর দেওয়া হল না!
“দীপুটা চিরকালের
বুরবাক,”
উল্টে অনির খোঁচা শুনতে হল, “এমন সুন্দরী বান্ধবীর জন্মদিন কেউ ভুলে
যেতে পারে!”
অনিকে ধমক দিয়েছিলে বটে কিন্তু
সে ধমকের মধ্যেও মিশে ছিল প্রশ্রয় আর আমার প্রতি অবহেলা।
ফেরার পথে একটা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে
ফেলে দিয়েছিলাম কষ্ট করে কেনা গোলাপগুলো। সারারাত ঘুমোতে পারিনি, অকারণেই চোখদুটো
জলে ভরে গেছিল।
তোমাদের ঘনিষ্ঠতার কথাটা আগেই
জানতাম। একদিন
টিউশনি সেরে ফেরার সময় দেখলাম গাড়ির ড্রাইভিং সিটে অনি বসে আছে, আর পরম
নিশ্চিন্তে ওর কাঁধে মাথা রেখে হাসছো। যেটুকু মোহ অবশিষ্ট ছিল তা একমুহূর্তে মিলিয়ে গেল। আনওয়ান্টেড
পার্সন হওয়ার জন্যে সযত্নে তোমাদেরকে এড়িয়ে চলছিলাম।
যথাসময়ে ডাক্তারি পাশ করলাম। অনি
বিদেশী ডিগ্রির জন্য বাইরে যাবে বলে ঠিক করলো আর আমি সরকারি হাসপাতালে চাকরি নিলাম।
তখনই শুনলাম তোমাদের বিয়ের ঠিক
হয়ে গেছে।
কষ্ট পেলেও মনকে বুঝিয়েছিলাম এ
বরং ভালোই হল,
আমার এই ভাঙাচোরা জীবনে এলে তোমার কষ্টের শেষ থাকতো না। তুমি সুখী হবে
এটা ভাবতেই এক অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা ভরে গেছিল।
সেই সন্ধ্যেটার কথা মনে আছে মধুমিতা, বিয়ের
নেমতন্ন করবে বলে কার্ড নিয়ে হোস্টেলের ঘরে এসেছিলে।
আমিও তো রক্তমাংসে গড়া মানুষ, তাই
সেদিন সামলাতে পারিনি।
হাতদুটো জড়িয়ে ধরে জানতে চেয়েছিলাম, আমার
ভালোবাসার কোন মূল্যই কি তোমার কাছে নেই! আমি কি এতটাই অপাঙ্ক্তেয়!
কিন্তু ভুল বুঝলে!
“ছি ছি, দীপঙ্কর...”
এক ঝটকায় হাতদুটো ছাড়িয়ে নিয়ে একরাশ ঘৃণার চোখে তাকালে, “এরকম জঘন্য প্রবৃত্তি
তোমার, এত নীচ
তুমি!”
বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম, স্বপ্নেও
ভাবিনি এতো বড়ো ভুল ধারণা করবে!
পরেরদিন অনি যাচ্ছেতাইভাবে অপমান
করল। কোনদিন
যদি তোমার ধারেপাশে দেখে সেটা ভালো হবে না বলে শাসিয়েও গেলো !
অনির ব্যবহার খারাপ লাগেনি, খারাপ
লেগেছিল ঘটনাটা তুমি যেভাবে ওকে বলেছিলে !
তারপর তো মফস্বলে চাকরি নিয়ে কলকাতা
ছাড়লাম। তোমাদের
সঙ্গে দেখা হলো দীর্ঘ পনেরো বছর পর, একটা মেডিকেলে কনফারেন্সের লাঞ্চ রুমে।
নাঃ, এসব কী ভেবে
চলেছে তখন থেকে। সিগারেটের
ফিল্টার টিপড স্টাম্পটা ফেলে দিয়ে ফ্ল্যাশ টেনে দিল।
তারপর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলেন
সেই চিরপরিচিত ডক্টর দীপঙ্কর বসু।
“প্লিজ দীপঙ্কর,” আই.সি.ইউ.
তে ঢোকার আগে অতি পরিচিত গলাটা শুনে দাঁড়াতেই হল, “যা’হোক কিছু
মুখে দাও,
নইলে শান্তি পাবো না!”
সাক্ষাৎ বিষাদপ্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে
আছে মধুমিতা। চোখের
তলায় কালি,
সুঠাম চেহারাটা দুদিনেই শুকিয়ে গেছে।
“প্লিজ,” শুকনো
ঠোঁটদুটো নেড়ে কোনক্রমে উচ্চারণ করল, “না হলে বুঝবো কোনদিন আমাকে ক্ষমা করতে
পারো নি!”
“আচ্ছা দাঁড়াও, অর্ককে
একবার দেখে আসি!”
নাঃ, বেশ তাড়াতাড়িই
উন্নতি করছে ছেলেটা। এই রকম
ভাবে থাকলে আগামীকালই এখানকার ডাক্তারবাবুকে সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতে পারবেন।
“হ্যাঁ, খেতে
পারি, কিন্তু
একটা শর্তে,"
আই.সি.ইউ. থেকে বেরিয়ে এলেন, “যতদূর জানি ডক্টর মজুমদার আর তুমিও কিছু
খাওনি। অতএব
খেতে হলে তিনজনকেই খেতে হবে!”
“বিপদ কেটে গেছে
মধুমিতা,”
একটু নরম সুরে বললেন, “এবারে কিছু খাও, নাহলে
অসুস্থ হয়ে পড়বে যে!”
চোখ ফেটে জল এলো। একদিন
এই মানুষটার সন্বন্ধে কত খারাপ ধারণাই না করেছিল। আর আজ সেই মানুষটাই
অর্কর জন্য অস্নাত অভুক্ত থেকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে মধুমিতার।
অনিকেতের চেম্বারেই সামান্য আয়োজন
- স্যান্ডউইচ,
চিকেন স্যুপ, স্যালাড আর কফি।
চুপচাপ খেয়ে চলেছে একসময়ের তিন
অভিন্নহৃদয় কলেজ বন্ধু। তিনজনেরই
মাথা নিচু - অনিকেতের লজ্জায়, মধুমিতার সঙ্কোচে আর দীপঙ্করের অস্বস্তিতে।
মধুমিতার মনে পড়ছে সেই মেডিকেল
কনফারেন্সের লাঞ্চ রুমের কথা। নিজেই উপযাচক হয়ে এগিয়ে গেছিল।
“কেমন আছ দীপঙ্কর?”
“ভালো!”
“তারপর, ফ্যামিলি
কোথায়?”
“ও পাট তো জীবনে
আসে নি!”
“সে কি, কেন!”
“কনে জুটলো না!”
একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিলেন।
“এ তোমার বাজে
অজুহাত দীপঙ্কর...”
আরো কিছু হয়তো বলতে যাচ্ছিল ঠিক
সেই সময়েই অনিকেত ডাকলো, “মধুমিতা, একবার এদিকে
এসো, আমাদের
স্যার, ডক্টর
দাশগুপ্ত।”
খেতে খেতে মধুমিতা ভাবছিলো সেদিন
অনিকেতের ডাকে সাড়া দিয়ে তক্ষুনি চলে না গেলেই ভালো করতো। কোন ডক্টর দাশগুপ্ত
নয়, দীপঙ্করের
সঙ্গে ওকে কথা বলতে দেখেই বিরক্ত হয়েছিল, কাছে যাওয়া মাত্রই অযথা কয়েকটা বাজে কথা
শুনিয়ে দিল।
কেন বিয়ে করিনি সে কথা তো বুঝবে
না, দীপঙ্করও
মনে মনে হেসেছিলেন। আজও
তুমিই মনে রয়ে গেছো, সেখানে অন্য কোন নারীকে স্থান দিতে পারবো না। যাকে
বিয়ে করে সঙ্গিনী করবো তাকে যদি ভালোই না বাসতে পারলাম তা হলে এ তঞ্চকতায় কি প্রয়োজন। বিয়েটা
তো ইন্দ্রিয়জ ব্যাভিচারের পাসপোর্ট নয়!
আর অনিকেত তো লজ্জায় দীপঙ্করের
সামনেই আসতে চাইছিল না। মধুমিতার
কথায় একরকম বাধ্য হয়েই একসাথে খেতে বসেছে।
কী দুর্ব্যবহারটাই না করেছে দীপঙ্করের
সাথে।
বিয়ের আগে তাকে চরম অপমান করেছে। এমনকি
এতদিন বাদে মেডিকেলে কনফারেন্সের লাঞ্চ রুমে মধুমিতার সাথে কথা বলতে দেখে মিথ্যে অজুহাতে
ওকে ডেকে নিয়েছিল।
“জানোয়ারটা আবার
তোমাকে বিরক্ত করছিল নাকি!”
অকারনেই রুক্ষস্বরে প্রশ্ন করেছিল।
“প্লিজ অনি,” চাপা
ধমক দিয়েছিল মধুমিতা, “আস্তে কথা বলো, শুনতে পাবে!”
“পাক, আই ডোন'ট কেয়ার, তোমার
সঙ্গে অসভ্যতা করেনি তো!”
“দীপঙ্কর অসভ্যতা
করার ছেলে নয় তা তুমি নিজেও জানো!”
“বিয়ের কার্ড
দিতে গিয়ে...”
“ওটা আমার মস্ত
বড়ো ভুল ছিল,
আরও বড়ো ভুল করেছি ঝোঁকের মাথায় কথাটা তোমাকে বলে!”
“আমাদের সম্পর্কটা
কোনদিনই ও মেনে নিতে পারেনি, আনকালচারড কোথাকার!”
অনিকেত খুব ভালো করেই জানে সেদিনকে
উচ্চারণ করা প্রতিটা শব্দ দীপঙ্কর শুনতে পেয়েছিল। যাতে শুনতে পায়
তো সেভাবেই বলেছিল কথাগুলো।
তারপর থেকে কারণে অকারণে দীপঙ্করের
সম্বন্ধে বাজে কথা বলে এসেছে। ডক্টর দীপঙ্কর বসু যে মেডিসিনে কলকাতার প্রথম পাঁচজনের
মধ্যে একজন সে কথা জোর গলায় অস্বীকার করে এসেছে।
ডাক্তারি মহলে সবাই জানে ডক্টর
দীপঙ্কর বসুকে ডক্টর মজুমদার সহ্য করতে পারে না।
কিন্তু দরকারের সময়ে কোথায় গেল
ডাক্তারি বিদ্যে, বিদেশের ডিগ্রী, বন্ধু বিশেষজ্ঞের দল।
সেই দীপঙ্করের হাতেই তো নবজন্ম
হল অর্কর।
কি করে চোখ তুলে কথা বলবে দীপঙ্করের
সাথে!
সহকর্মীদেরকেই বা কি বলবে!
ঘরেই বা কোথায় রইলো সম্মান!
মধুমিতার সামনে আর কোনদিন সোজা
হয়ে দাঁড়াতে পারবে!
চিরদিনের জন্য ধুলোয় মিশে গেল
ডক্টর অনিকেত মজুমদার।
“মনে হচ্ছে আজ
রাতের মধ্যেই অর্কর ক্রাইসিস পিরিয়ডটা ওভার হয়ে যাবে.” দীপঙ্করই অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতাটাকে
ভাঙ্গলেন,
“তাই কাল সকালবেলাই চলে যাব ঠিক করেছি।”
“তুমি আর থাকবে
না...” খাওয়া থামিয়ে অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করল মধুমিতা।
“আমার দরকার তো
শেষ হয়ে গেছে,
শুধু শুধু...”
“প্লিজ দীপঙ্কর,” এবারে
মিনতি করলো অনিকেত, “তুমি থাকলে...”
“কালকে অবধি তো
আছি। আর অবস্থা
যা বুঝছি তাতে এরপর তুমি নিজেই ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে পারবে। সেক্ষত্রে
আমার থাকার...”
“তবু, তুমি
থাকলে মধুমিতা একটু ভরসা পেত,” কুন্ঠিত ভাবে বলল অনিকেত।
“আমার যা বলার
তা তো বললাম ডক্টর মজুমদার,” অকারণেই দীপঙ্করের গলাটা রুক্ষ হয়ে উঠলো, “আর যেখানে
প্রয়োজন নেই সেখানে থাকাটা উচিত বলেও মনে করিনা।”
একটু বেশি শব্দ করেই চেয়ারটাকে
ঠেলে সরালেন। তারপর
গম্ভীর মুখে “এক্সকিউজ মি” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
রুক্ষ ব্যবহারটা কার সঙ্গে করলেন
দীপঙ্কর - মধুমিতার, অনিকেতের নাকি নিজের সঙ্গে।
আসলে নিজেকেই তো ধমক দিলেন।
কেন লোভীর মতো বারে বারে মধুমিতার
সঙ্গসুখ ইচ্ছে করছে।
যাকে বরাবরের মতো নিজের জীবন থেকে
মুছে ফেলতে চেয়েছেন তার কথা কেনই বা মনে আসতে চাইছে!
অবচেতন মনের মধ্যে থাকা অসভ্য
পুরুষটাকে তো এতকাল দমিয়েই রেখেছেন। মধুমিতা তো এখন মিসেস অনিকেত মজুমদার, আর পাঁচজন
পুরুষের মতো তাঁর কাছেও পরস্ত্রী!
তাহলে, কেন
তাকে প্রত্যাশা করবেন দীপঙ্কর !
নিজের ওপরে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ আছে। এমনকি
এজন্যে চাপা গর্বও আছে। ভালোবাসাহীন
সম্পর্ক থেকে সচেতনভাবেই দূরে থাকতে চান।
- তাহলে, এতো
কিছু সত্ত্বেও কেন ছুটে এলে ডক্টর দীপঙ্কর বসু!
কাল থেকেই মনের অবচেতনে লুকিয়ে
থাকা বদমাইশটা ক্রমাগত খুঁচিয়ে চলেছে।
- সত্যি করে বলতো, মধুমিতার
চোখে নতুন করে নায়ক হবার প্রত্যাশা নেই!
- স্টপ ইট, আই সে!
- হাঃ, হাঃ, ডক্টর
বসু, ধরা
পড়ে গেলে তো!
- না, সে জন্যে
আসি নি, বাচ্ছা
ছেলেটা এভাবে চলে যাবে...
- সো হোয়াট, এর আগে
কোন বাচ্ছাকে মরতে দেখোনি নাকি সদ্য সন্তানহারা মায়ের হাহাকার করা কান্না শোনোনি। এতো
তোমার প্রফেশনের পার্ট অ্যান্ড পার্সেল!
- অল রাইট, অল রাইট, আই কনফেস। হ্যাঁ, ছেলেকে
হারিয়ে মধুমিতা ওইরকমভাবে কাঁদছে এটা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা। সেই জন্যেই খবরটা
শোনামাত্র ছুটে এসেছি। এবারে
হয়েছে শান্তি! ছেলেকে ওর কাছে ফিরিয়ে দেব এটাই একমাত্র উদ্দেশ্য, তারপর
স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকুন মিসেস মজুমদার। আই ডোন্ট কেয়ার, আই ডোন্ট
বদার। আর শুনে
রাখো, মধুমিতাকে
বুঝিয়ে দিতে চাই কোন অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সেদিন হাতদুটো ধরিনি।
- বেশ, তারপরেও
মধুমিতা যদি তোমাকে দেবতা বানিয়ে পুজো করতে চায়, উজাড় করে দিতে
চায় অর্ঘ্যের ডালি!
- কঠোর প্রত্যাখ্যান
পাবে!
- এই বয়সেও মধুমিতা
কিন্তু সেইরকম সুন্দরীই রয়ে গেছে!
- উইল য়ু প্লিজ
লিভ হিয়ার নাউ!
- হাঃ, হাঃ, হাঃ, হাঃ, ডক্টর
বসু, কথাটা
কিন্তু একবার ভেবে দেখলে পারতে!
কনিয়াকের বোতলটা এই সময়ে খুব দরকার
ছিল। মনের
অতলে লুকিয়ে থাকা অস্বস্তিকর এইসব প্রশ্নগুলোর হাত থেকে অন্তত নিস্তার পাওয়া যেত। কিন্তু
এই নন-অ্যালকোহলিক জোনে সেটা যখন সম্ভব নয় তাহলে কিছুক্ষনের জন্য ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। সারাদিন
পর শরীরটা একটু বিশ্রাম চাইছে। তার আগে অর্কর অবস্থাটা একটু দেখে নিতে হবে।
নাঃ, ঠিকই আছে ছেলেটা, আচ্ছন্নের
মতো ঘুমোচ্ছে। ভেরি
গুড, যত ঘুমোবে
তত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।
এবারে চেয়ারে বসেই চোখদুটো একটু
বুজে থাকতে হবে। আর তো
মাত্র কয়েকটা ঘন্টা, কালকে অর্ক এর থেকেও ভালো অবস্থায় চলে আসবে। ব্যাস
তাহলেই ওর ছুটি,
মধুমিতার কাছ থেকে আবারও দূরে চলে যেতে পারবে।
“দীপঙ্কর চলে
যাচ্ছে মধুমিতা,”
ইতস্তত করলো অনিকেত, “ওর সামনে দাঁড়ানোর মতো স্ট্যামিনা আমার
নেই, তুমি
যদি একবার....”
“ঠিক আছে, দেখছি!”
“দীপঙ্কর...”
গাড়িটা স্টার্ট করতে যাবে এমন
সময়ে আবার সেই পরিচিত কণ্ঠে ডাকটা শুনতে পেলেন। দ্রুতগতিতে সিঁড়ি
দিয়ে নেমে আসছে মধুমিতা।
কত অপমানই না একদিন সহ্য করতে
হয়েছে ওই মানুষটার জন্যে। তবু
তার ডাক উপেক্ষা করার মতো শক্তি আজও হলো না!
শেষ মোকাবিলাটা করার জন্যে গাড়ী
থেকে নেমে দাঁড়ালেন।
“এভাবে আমাকে
ঋণী করে রেখে চলে যাচ্ছ,” কোনরকম বাধা দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই হাত
দুটো নিজের হাতে নিলো মধুমিতা, “এতো বড়ো শত্রুতা করতে পারলে!”
“অনি কোথায়?”
“নিজের চেম্বারে, লজ্জায়
তোমার সামনে আসতে পারলো না!”
“ও, তাই
নিজেই কর্তব্যপালন করতে এসেছো!”
“যা প্রাণে চায়
বলে যাও,”
ধরা গলায় নিজেকে সামলাতে সামলাতে জবাব দিলো, “আজ তো তোমারই
বলার দিন!”
“কী বলবো মধুমিতা?”
“এতদিন বাদে যা
বলতে এসেছিলে!”
“সে কথা যখন বুঝেই
গেছ তখন কষ্ট করে আর নাই বা বললাম!”
“উঃ, আমার
প্রতি কি একটুও মায়াদয়া নেই!”
“শত্রুর কাছ থেকে
ওসব নাই বা এক্সপেক্ট করলে!
“কি ভেবেছো কি
তুমি,” এবারে
নিজেকে সামলাতে পারলো না, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, “সব কষ্ট
একা তোমার,
আমি কোন কষ্ট পাইনি, তাই তো! অন্যায় করেছিলাম, তার
জন্যে প্রতিমুহূর্তে অনুশোচনায় জ্বলে পুড়ে মরেছি। বিরাট বড়ো ডাক্তার
হয়ে গেছ তাই না,
পারবে আমার মনের জ্বালার সে রিপোর্ট বার করতে!”
চুপ করে থাকা ছাড়া এই মুহূর্তে
আর কিই বা করতে পারেন দীপঙ্কর!
“আবার কবে আসবে!”
কান্নার বেগটা একটু কমতে মধুমিতা প্রশ্ন করলো।
“কি দরকার, তোমার
থেকে দূরেই না হয় রইলাম!”
“শত্রু হিসাবেই
তাহলে থেকে যাবে!”
স্থির দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে
থাকার পর অদ্ভুত গলায় থেমে থেমে উচ্চারণ করলো।
“ওয়ান ক্যান’ট
মেক থাউজেন্ডস অফ ফ্রেন্ড," মৃদু গলায় কথাগুলো উচ্চারণ করলেন দীপঙ্কর, "উইডাউট
হ্যাভিং অ্যাটলিস্ট ওয়ান এনিমি!”
“ফিলজফির প্রফেসরকেই
ফিলজফি শোনাচ্ছ!”
“আচ্ছা,” হাসলেন
দীপঙ্কর,
“এবারে চলি,
ভালো থেকো!”
গাড়িটা দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে, কিন্তু
ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটাকে আজও চিনে উঠতে পারলো না মধুমিতা।
অবশ্য কোনদিন চেনার চেষ্টা করেছিল
কি!
| ALEEK PATA- Your Expressive World | Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Bengali New Year 2024 | April-24 | Seventh Year First Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| Published By : Aleek Publishers- www.aleekpublishers.com |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |
বেশ ভালো লাগল।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete