দন্ত্যস্থ
(দ্বিতীয় পর্ব)
স্বরূপ চক্রবর্তী
সংখ্যা-১৬, (৬ ই জুলাই,২০১৮) |
(৪)
একেবারে ভোর রাতে ধানাই-পানাই, থুড়ি, নন্দী- ভৃঙ্গী মহাদেবের সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে সব ব্রিফ করল শুধু গাঁজা খাওয়ার
ব্যাপারটা সযত্নে এড়িয়ে গেল, কারন ডিউটি আওয়ার্সে নেশা করা বাবার না পসন্দ।
মহাদেব ওদের কাজে খুশি হয়ে হৃষ্ট চিত্তে বললেন , যা ব্যাটারা, আজ তোদের ছুটি, আর এই নে পেসাদ, বলে গাঁজার কলকে টি ওদের হাতে তুলে দিলেন।
ওদিকে সকাল থেকেই
মা দুর্গা, গণেশ ও কার্তিক সাজুগুজু করে একেবারে যাকে বলে ‘রেডি’।
বেরোবার আগে মা ছেলেদের নিয়ে শিবঠাকুরের কাছে এলেন, বললেন ,"এগোচ্ছি, তোমার জন্য পান্তা ভাত আর আলুসিদ্ধ করে রেখে যাচ্ছি, যা গরম, এবারে তো দেখছি কৈলাশেও শান্তি নেই",
মহাদেব স্মিত হেসে বললেন ," আমার জন্য ভেবো না, আর , বাসুদেবপুর বাজারে নন্দীরা গিয়ে খবর নিয়ে এসেছে, ওখানে জটাধর বস্ত্রবিপনীর মালিক হলধর পাঁজা খুব ভালো লোক, আমাকে মন্যি করে, বড় কাপড়ের দোকান, ওখান থেকেই তোমরা তোমাদের জিনিষ খুঁজে নিও"।
বাবার কথা শুনে মা খুব খুশি হলেন, ভাবলেন, মানুষ টা যেমনই হোক, আমাকে খুব ভালো বাসে।
"আর শোনো", বাবা চালিয়ে যান,
"একটা কথা মনে রেখ, ওখানে গিয়ে নিজেদের স্বরূপ প্রকাশ করবে না, আর দৈব শক্তি প্রয়োগ নৈব নৈব চ, ওই ব্যাটা মর্তবাসী দের কোনও হক নেই ওদের ওই পাপ চক্ষে আমাদের দেখার, মনে থাকে যেন", চোখ পাকিয়ে সাবধান করলেন ভোলে বাবা।
মা মাথা নিচু করে ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন; আর বললেন,"আচ্ছা , চলি, আর তুমি কিন্তু ওই ছাইপাঁশ গাঁজা খাবেনা মোটেই, তোমার আবার গরমে এইসব সহ্য হয়না।"
“রটন ওল্ড ফ্যাশনড ন্যাকা ফ্যামিলি প্রেম, একে অপরের স্পেস হ্যাক করে খবরদারি",” কি হলো, চলো", কার্তিক তার বিরক্তি প্রকাশ করল।
আচ্ছা আচ্ছা আসছি বাবা, বললেন মা।
(৫)
সবে মাত্র সকাল হচ্চে, আকাশ হালকা হলদে বরণ ধরেছে, বাসুদেবপুর বাজারের এক কোনায় খাঁড়ির এক্কেবারে গা ঘেঁষে
অবস্থিত বাসুদেবপুর থানা, বাজার খুলতে এখনো অনেক দেরি, কিন্তু এই ভোরেই থানার ইনচার্জ হরিপদ সরখেল ব্যাজার মুখে ডিসচার্জড হয়ে চেয়ারে এলিয়ে বসে আছেন, একে তো কুটকুটে গরম, তার ওপর সিলিং ফ্যানটাও যেন ঘুরতে চাইছে না, কনিষ্ঠ কনেস্টবল নীলরতন প্রানপনে হাত পাখা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু গরম যেন আর কমেই না।
বছর পঞ্চান্নর হরিপদর মনে মোটেই সুখ নেই, কারন আজ প্রায় সাত বছর হলো এই পাণ্ডব বর্জিত জঙ্গলে শাস্তিমূলক পোস্টিংয়ে পড়ে আছেন, ওনার প্রমোশোনও আটকে আছে, তার জন্য উনি নিজেকে মোটেই দোষারোপ করেন না,
হতে পারে যে দু একটা ঘুষের আর কয়েদি ফেরার হবার মামলা চলছে ওনার নামে, তা, সে আর এমন কি, অমন এক আধটা মামলা তো থাকতেই পারে, তা, বলে এই শাস্তি!
এইত সেদিন, সদরে গিয়েছিলেন একটি কেসের তদ্বির করতে, তা , বড় সায়েব বললেন,
“দেখুন মশাই, প্রোমোশনের কথা আপনি ভুলেই যান",
"হেঁ হেঁ, ক্যানো সার?"
"এসব ছোট খাটো চোর বাটপাড় ধরে আপনি নিজের
ক্যারিয়ারের কালি মুছতে পারবেন না", "যদি ভালো কোনও কেস সলভ করতে পারেন, তাহলেই আমার কাছে তদ্বির করতে আসবেন, না হলে নয়, ঘুষ আমি নিই না, আর, যাবার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যাবেন।"
স্পষ্ট ইঙ্গিত বুঝে কোনও ক্রমে হতাশা সামলে বিমর্ষ সরখেল দরজার দিকে পা বাড়াতেই বড় সায়েব বলে উঠলেন, " গত পরশু আপনার চেলা নীলরতনের হাতে যে রসগোল্লার হাঁড়ি টি পাঠিয়ে ছিলেন , সেটার মধ্যে কতগুলি যেন পচা পচা ঠেকছিল, নেহাতই আমার বাচ্চাটা হ্যাঙলা, সবকটা মেরে দিল তাই, না হলে গিন্নি বলছিলেন যে আপনি এলে আপনাকে জল খাবারে খাওয়াবেন, যত্তসব আনাড়ী, ওদিকে গিন্নির আবার একজোড়া ঝুমকো দুলের শখ হয়েছে, আমার সময় নেই, তা, আপনি কি জানেন কোনো স্যাকরার খবর, যেখানে খাঁটি মাল পাওয়া যাবে?"
সরখেল হালে পানি পেয়ে আকর্ন বিস্তৃত হাসি দিয়ে বললেন, " হেঁ হেঁ , কি যে বলেন স্যার, আমি কালই বাসুদেবপুরের সেরা স্যাকরার থেকে স্যাম্প্যাল পাঠিয়ে দেব 'খন, সাথে সুন্দর বনের খাঁটি মধু,", "আরে, নাআআআ, না, দাম নিয়ে কিস্যু ভাববেন না, ওটাতো আর ঘুষ নয়, ওটা আমার তরফ থেকে বৌদি আর ভাইপোর জন্য
কিঞ্চিৎ ...মানে... উপহার... মাত্র...., আর, ইয়ে, স্যার, আমার, মানে, ফাইলটা যদি ... একবার",
"বললাম না, কোনও ভালো কেস সলভ করুন, তবেই আপনার ফাইল মুভ করবে, নচেৎ নয়"।
সরখেল হাঁড়ি মুখে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন….
"এই হারামজাদা ন্যালা, বলি ঘুমিয়ে পড়লি না কি ব্যাটা, হাত পাখাটা জোরে জোরে চালা"
"শরীরটা বড্ড ম্যাজ ম্যাজ করছে, আলস্য কাটাতে একটা বিশাল হাই তুলে কোনও মতে আড়াইমনি শরীর টাকে চেয়ার থেকে মুক্ত করে সরখেল হাতে রুলটি তুলে নিয়ে হাজতের দিকে এগিয়ে গেলেন, হাজতের ভেতরে তিনজন কয়েদি ছিল, দুইজন কে দেখলেই বোঝা যায় যে, এই হাজত টি হল তাদের ঘর বাড়ি, দিব্যি দুই জনায় বাজি রেখে তাস খেল ছিল, তৃতীয় জন একটি বছর বিশের যুবক, দেখলেই বোঝা যায় শিক্ষিত , ভদ্র, সে হাজতের এক কোনায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ছিল, সরখেল কে ভেতরে আসতে দেখে প্রথম দুই জন উঠে সেলাম ঠুকল, আর সরখেল বিনা বাক্য ব্যয় করে এলো পাথাড়ি রুল
চালাতে লাগল, আর ওরা যথা সাধ্য চেষ্টা করছিল বেঁকে চুরে মার এড়াতে, মিনিট পাঁচেক এভাবে চলার পর সরখেল হাঁপিয়ে মার বন্ধ করল, কয়েদি দুটো সরখেল কে সমীহ করে বলল, "স্যার, লাগেনি তো?", "আপনার দয়ায় কিছু করেকম্মে খাচ্ছি, আপনি চোট পেলে যে আমাদের নরকেও ঠাঁই হবে
না", আশীর্বাদের ভঙ্গীতে ওদের মাথায় হাত রেখে সরখেল মুড়লেন সেই যুবক টির দিকে,মিচকি হেসে বললেন " তা, শালা বাবু, কেমন আছেন? আপনার জামাই বাবুকে খবর পাঠানো হয়েছে, উনি আপনার জন্য জামিন নিয়ে এলেই আপনি ছাড় পেয়ে যাবেন, আর যদি না আসেন..হেঁ হেঁ, তাহলে এই রুল দিয়ে....", বলে রুলটি ছেলেটির নাকের সামনে ঘোরালেন।
"আপনি কিন্তু অন্যায় করছেন স্যার, আমি কিছুই করিনি, দিদি জামাই বাবুর বাড়িতে বেড়াতে আসা কি অন্যায়?" ছেলেটি বলে উঠল।
"না, না, না,না, সেটা অন্যায় হবে কেন? কিন্তু আমার এলাকায় বড়লোক স্যাকরা হওয়া পাপ, সেই স্যাকরার শালা হওয়া পাপ, আর আরও পাপ বড় সায়েবের গিন্নির যখন ঝুমকো দুলের শখ উঠবে তখন জামাই বাবুর বাড়ি বেড়াতে আসা", "বুঝেছ হে ছোকরা? বেশি আইন দেখিও না, এটা কলকাতা নয়, বাসুদেবপুর, এখানে কয়েদিদের আমি আকছার হাপিস করে দিই, কেউ জানতেও পারে না"।
বলে সরখেল হৃষ্ট চিত্তে নিজের চেয়ারে এসে এলিয়ে বসলেন, বেলা প্রায় সাড়ে আটটা, ইতিমধ্যে নীলরতন মোড়ের দোকান থেকে তেলেভাজা, গরম জিলিপি আর
মুড়ি নিয়ে এসে দারোগা বাবুর সামনের টেবিলে পাতা খবরের কাগজের ওপর
রেখেছে, দারোগা গিন্নির রাতে টিভিতে হিন্দি সিনেমা দেখে শুতে রাত হয়, তাই সকালের জলখাবার টা দারোগা সায়েব এই থানাতেই সারেন।
মুখে একমুঠো মুড়ি আর আধখানা চপ ফেলে দারোগা বাবু কাগজে মন দিলেন।
প্রথম পাতাতেই এক্কেবারে বড় বড় হেডিং, " রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য", পুরো খবরটা পড়েই হরিপদ সরখেল লাফিয়ে উঠলেন, " আরে!! এত একেবারে আমার নাকের ডগায়"।
"কি স্যার? মাছি?" , বলে উঠল নীলরতন ওরফে ন্যালা।
হরিপদ খেঁকিয়ে
উঠলেন, "চোপ , মাছি নয় রে হতভাগা, বাঘ,"
আতঙ্কিত নীলরতন ইতি উতি দেখে ভয়ে ভয়ে বলল, "বা..ঘ, কক..কোথায় স্যার?"
আসলে একেবারে
খাঁড়ির এপারে
লাগোয়া এই বাজার ও থানা এলাকা। খাঁড়ির ওপারে লাগোয়া সুন্দর বন থেকে ইয়া ইয়া কেঁদো সাইজের বাঘ মাঝে মাঝে জল খেতে চলে আসে, যদিও খাঁড়ি পেরিয়ে এপারে কোনো দিন আসেনি, তবে আসবেনা, তার গ্যারান্টি কোথায়?
হরিপদ বললেন,"
আমার নাকের ডগা
দিয়ে... বাঘের ছাল পাচার!দাঁড়া, দেখাচ্ছি "
শুনে নীলরতন হাঁফ ছাড়ে।
তড়িঘড়ি ভুঁড়ি ওয়ালা পেটের ওপর বেল্টটা টাইট করে শার্টের কলার ঠিক করে সিধে হয়ে বসলেন সরখেল, ভাবলেন এই মওকা, কেসটা সলভ করতে পারলে কেল্লা ফতে, পেয়ারের নীলরতন কে কাছে ডেকে চাপা গলায় সমস্ত প্ল্যানটা বোঝালেন , " শোন ন্যালা, তুই আজ থেকেই লেগে পড়, চারিদিকে খেচর লাগা, ওই পোচাররা, বাঘের ছাল পাচার করার আগেই ওদের পাকড়াও করা চাই,তাহলেই আমার এই নির্বাসন থেকে মুক্তি, আর তোরও একটা হিল্লে হয়।
প্রথম পর্ব
তৃতীয় পর্ব
ক্রমশঃ
প্রথম পর্ব