নতুন জন্ম
শম্পা সান্যাল
সংখ্যা-১৩, (২০ শে জুন,২০১৮) |
বিজন অফিসে বেরোবার সময় অতসীকে সমস্ত রেডি করে হাতের কাছে এগিয়ে দিতে হয়, আজও তার ব্যতিক্রম নেই, তারই ফাঁকে বললো"আমাকে কিছু টাকা দিয়ে যেও"।
কেন, টাকার দরকার কিজন্য ?
কাল গুড ফ্রাইডে পড়াতে বুয়াদের তিনদিন ছুটি, আজ ওদের নিয়ে বাবা-মাকে দেখতে যাবো।
বাঃ, এখন বলছো! একেবারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ?
মাকে বলেছি, মা মত দিয়েছেন তো।
আর আমার সুবিধা অসুবিধা সেগুলো কে দেখবে ?
সব তো গুছিয়ে রেখে যাই, এবারও যাবো আর ছুটি আছে তো তোমারও।
না, আমার ছুটি নেই। বাদ দাও, ভাবতে হবে না।
অনেকদিন যাই না, ছুটি ছোট হয়েও ওঁদের দেখাশোনা করে,আমি তো ফোন করে....
হ্যাঁ, কর্তব্য মানে তো গুচ্ছের টাকা....
কি বলছো!টাকা ধ্বংস করে আসি! কি করেছি ওদের প্রয়োজনে ? এভাবে কথা বলো না, যাতায়াতের জন্য যেটুকু লাগে সেটা কি অন্য কারো কাছে চাইবো?
থামো, অফিস যাওয়ার সময় যত ঝামেলা।
বড় জামাই হয়ে কতটুকু কর্তব্য করো! মা-বাবা তো তাই নিয়ে
থাকলো, চললাম। লেকচার থামাও, হুঃ, টাকা যেন....
আজ যদি তুমি না থাকতে বড়দি ছোড়দি মা-কে দেখতো না
আমার মা যা পেনশন পায় তাতে কারোর পরোয়া করার দরকার পড়ে না বুঝেছো!!
অপমানে আজও জ্বালা ধরে মনে। বাক্-রুদ্ধ হয়ে বিছানায় বিজনের ছুঁড়ে ফেলা টাকার দিকে তাকিয়ে থাকে অতসী। নিজের উপরেই ঘেন্না ঝরে পড়ে অসহায় অতসীর।
দুই মেয়ে পর পর, বাবা বেসরকারি চাকুরীজীবি, বিজনের সাথে অতসীর সম্বন্ধ আসলে বাবা-মা হাতে চাঁদ পেলেন যেন। রূপের জন্য বাধা এলো না কিন্তু বিয়ের পর যত সময় গড়িয়েছে অতসী অসম পরিবারে বিয়ের মর্ম বুঝেছে, বুঝতে পারছে। স্কুল থেকে ফিরেই ছেলেমেয়ের আব্দার কতক্ষণে দিদান বাড়ি যাবো! ছুটিও আসবে, কতদিন পর দু-বোনে একসাথে থাকবে! বিকাল বিকাল যতটা পারলো সংসারের কাজ সেরে শ্বাশুড়ির অনুমতি নিয়ে বেরোলো। শ্বাশুড়ি ওকে সেভাবে দেখেন না, এটাই স্বান্তনা। ছুটি মা-কে মোবাইল কিনে দেওয়াতে এই সুবিধা, খবর দিতে পেরেছে। আগে আগে বুথ থেকে বাবাকে ফোন করতে হতো, দুটো বেশি কথাও বলতে পারতো না। এতক্ষণে তাঁরাও নিশ্চয়ই অস্থির, ঘর-বার করছে। আজকেও বাবা নির্ঘাৎ গলির মুখে দাঁড়িয়ে, এইসব ভাবতে ভাবতে অবশেষে বাড়ির কাছে এসে দ্যাখে সত্যিই বাবা দাঁড়িয়ে।রিক্সা থেকে নেমেই বাচ্চারা দাদুন দাদুন বলে ছুট্ লাগালো।মনে এলো ছোটবেলার কথা বাবার অফিস থেকে ফেরার সময় হলে মা-ও ঘরে-বাইরে করছেন আর দেখতে পেলেই দুই বোনের ছুট্, কে আগে যাবে। নিত্যদিন বাবার হাতে বাজারের থলে, পিছনে মায়ের চিৎকার" পড়ে যাবি, আরে মানুষটাকে আসতে দে তোরা", গলায় প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের সুর আর বাবার সারাদিনের গ্লানি নিমেষে উধাও কি করছিলে, মা-র কথা শুনছো না!! পড়া হয়ে গেছে জানো বাবা আজকে না......কত কথা!কলকল করে দুজনে বলে যেত, শেষে মায়ের ধমক।মজা এটাই এখন বাড়িতে এলে খানিক বাদে বাবা মার নামে আর মা, রাজ্যের অভিযোগ মেয়ের কাছে।
মায়ের চোখে জল, জড়িয়ে ধরে মাকে।বাবা-মা কি করবে আনন্দে, কাকে ছেড়ে কাকে আদর করবে, কি খাওয়াবে, তারই সাথে কত কথা। কথা তো অতসীর বুকেও জমা, পারেনা বলতে। বাপের বাড়ি পা দিলেই যেন কেমন আলস্য। সকালে সাত তাড়াতাড়ি বিছানা ছাড়ার তাড়া নেই, শুয়ে বসে মাকে টুকটাক সাহায্য, দু-বোনের গল্পে কেটে যায় বরাদ্দ সময়। অদ্ভুত! দুই চরিত্রে দুই বাড়িতে অবস্থান করে একটি মেয়ে।
প্রকৃতির নিয়মে সময় গড়িয়ে গেছে অনেকটাই।বাচ্চারা আজ তাদের বাচ্চাদের নিয়ে দারুণ ব্যস্ত। কর্মব্যস্ত জীবনে এসেছে অবসর। বিজন ছেড়ে গেছে ওদেরকে।কত কথা, কত স্মৃতি! আজ বিজনের সৌজন্যেই হাত পাততে হয় না কারো কাছে। টিয়া-রজত এসেছে, বুয়াদের সাথে জমিয়ে আড্ডার আওয়াজ আসছে, এই টুকু ভাইবোনের মধ্যে থাকুক অতসীর একান্ত কামনা এটাই। নাতি নাতনিদের হুটোপাটি আজ বোঝে বাবা মায়ের আনন্দের অনুভূতিকে। অন্যমনস্কতা কাটে সোমার ডাকেমা, একা কি করছো, ওঘরে চলো না
ছিলাম তো, এই একটু টান হলাম, বল্।
পনেরো- কুড়িজনের জন্য পোলাও বানাতে কি কি কতটা পরিমাণে লাগবে বলোনা!
এতজনকে জোগাড় করলি কি করে, কেন ?
মামনি, দেখো না কালকে কতজন আসবে!
কেন রে, কালকে কি ??
ঐ গেট টুগেদার আর কি, বলো না
সে ভালো তবে এতজনের হ্যাপা নিতে গেলি কেন, আমাদের ঐ ক্যাটারারকে বললেই পারতি!
না ,না আমি একা না। দিদিভাই, মাসীমনি সবাই মিলে করবো।
ও বাবা! ছুটিও আসছে?
মামনি, আমার বাপী-মাও আসছেন।
এবার আমার ভারি রাগ হচ্ছে, আমি কিছু জানিনা
সোমা হাসতে হাসতে বলে " মামনি, ছেলেরা বলেছে ওরা নাকি পরিবেশন করবে।"
বাঃ, আর আমাকে কি দায়িত্ব নিতে হবে শুনি!
সবার সাথে আনন্দ করে সবাইকে দেখাশোনা করো, কেমন! আর পোলাও! ওটা তো তোমাকেই করতে হবে।
রাতে বুঝতে পারে কাল কিছু একটা হচ্ছে, ওকে বাচ্চাগুলোও বলছে না, হেসে দৌড় মারছে। সকালে পুজো সেরে উঠতে উঠতেই এক এক করে সবাই আসতে লাগলো। কতদিন পর ছুটি এলো, দিদি বলে জড়িয়ে ধরলো যেন মাকে জড়িয়ে ধরেছে এমনই অনুভূতি দুজন দুজনকে জড়িয়ে। একই সাথে হতচকিত সবার হাতে ফুল-মিষ্টি ইত্যাদি দেখে অতসী এসব কি!! সমস্বরে সকলে বলে ওঠে " হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, শুভ জন্মদিন....
নীরবে, অশ্রুসজল চোখে মনের মাঝে বেদনার ভার বহনকারী অতসী সবার মনে আসন পেয়েছে, দারিদ্র্য,অল্প শিক্ষিত পরিচয়ের উপরে ভালোবাসার পরশে আপন করে নেওয়া ফিরিয়ে দিল সুদে-আসলে সত্তোরোর্ধ্ব বয়স। আনন্দাশ্রু গড়িয়ে এলো চিবুক ছুঁয়ে।