মাতলো
রে ভুবন
|
Image Courtesy :Google Image |
“সর্বজনীন!! দুগ্গোপুজো ?? কাদের? কাদের নয় বলুন তো!এই পুজোর
সাথে সবার আনন্দ জড়িয়ে থাকেতো বটেই এছাড়া” ....... কলেজের শেষ প্রহরের
আলাপচারিতায় ভেসে এলো বিতর্ক। সুমেধা বেরোতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে
দেখে স্টাফরুম থেকে বেরিয়ে এলো।আজ দুদিন বৃষ্টির পর রোদ উঠেছে, গেটের সামনে ট্যাক্সি পেয়ে
গেল। আর মাস দেড়েক আছে পুজোর, এখন থেকে একটু একটু করে কিনে না
রাখলে বড় সমস্যা হয়। গড়িয়াহাট বলে গা এলিয়ে বসলো। মনের মধ্যে কলিগদের
বিতর্কিত বিষয়টা ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ সাথেও কেউ নেই, ফেরার সময় দু-একজন থাকেই।
টিউটোরিয়াল পিরিয়ডের জন্য এক্সট্রা ক্লাস নিতে হচ্ছে ফলে
ছুটি পেলো আজ দেরীতে। এখন সেকারণে কয়েকদিন, আগে ছুটি মিলবে না জানে।
মলিনাদির কাপড় দেখে শ্বাশুড়ি বিরক্ত, তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি ; বিধবা, আর এত ভালো শাড়ি নিয়ে ও করবেই
বা কি!
-“মা, মলিনাদির কি বয়স বলো!”
-“শোনো, মাথায় তুলো না।“
-“তোমার শাড়ি দুটো পছন্দ হয়েছে
তো! সবসময় পরার শাড়িই তো বেশি লাগে তাই ভাবলাম একটা দামী শাড়ি না
নিয়ে দুটো কিনি। ভালো লেগেছে ? না হলে বলো, পাল্টানো যাবে।“
-“না, না আমার আর ভালো-মন্দ! এই তো
বড় বৌমা দেবে, শিউলি .....”
-“সেইতো, মা এবার ছোটদের জন্য টাকা দিয়ে
দিলাম, এত মাপের প্রবলেম হয়!”
-“সে যা ভালো বুঝেছো!”
-সুমেধা বোঝে মেজাজ বিগড়ে গেছে।
আরে বছরে তো একবারই দিই আর মলিনাদি এত ভালো, যাকগে এখন ননদদের শাড়ি!ওটা
মাকে নিয়েই যাবে। কলেজের কৃষ্ণাদির পরামর্শ, বিয়ের প্রথম বছরেই বলে
দিয়েছিলো, মূল্যবাণ পরামর্শ। অবশ্য ওদের ভাইফোঁটায় প্রাপ্তি, ধীরে সুস্থে কিনলেও হবে। মায়ের
জন্য যে কি কিনি!! বাবা যাওয়ার পর মার কিছুতেই যেন আর আগ্ৰহ নেই, ওদিকেও ভাই বোনকে, বৌদি, ছেলেমেয়েদের জন্য। উফফ্, প্রতিবার ভাবে একটু একটু করে
অনেক আগে থেকেই শুরু করবে, সে আর হয়ই না। প্রতিবছরের প্রতিচ্ছবি।
স্টাফরুমেও এখন কেনাবেচা, পুজোর বাজার প্রধান আলোচ্য বিষয়। কে কোন্ জায়গায় কত কমে
পেয়েছে, ঠকেছে এমনকি ঘনিষ্ঠ মহলে "দ্যাখ্ তো , এটা অমুকের....." ইত্যাদি
চলছে। যথারীতি পুরুষেরা আওয়াজ দিচ্ছে, এত যে সমস্যা সংক্রান্ত আলোচনা এ 'ক'দিনের জন্য হাওয়া-কেন্দ্রবিন্দুতে ' শারোদোৎসব'। এর পাশাপাশি আছে কমন প্রশ্ন, এবার কোথায় ?? এও যেন এক রীতিতে পরিণত হয়েছে।
সুমেধার বাবা বলতেন বৃষ্টির ধারাপাতে প্রকৃতি শুচিস্নাত হয়ে চারধার
আলো করে আগমনীর বার্তা দেয়, তৈরি করে পরিবেশ। এ সময় বাড়ি থাকবে আলো ঝলমল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এ সময় বাংলার বাইরে থাকার প্রশ্নই ওঠে
না। সত্যি, কি অদ্ভুত না! প্রতি বছরই মানুষের এই পুজো ঘিরে উন্মাদনা। যত লোক
বাইরে যাক্ দ্বিগুণ লোক আসে দেখতে। মা বাপের বাড়ি যেতে পারতেন না পিসিমনির বিয়ের পর
থেকে। পিসিমনিরা আসতেন, সুমেধা বলতো আমরা যাবো না মা, আগে তো যেতাম। মা বলতেন ওরা
এসেছে, আমি বাড়ি না থাকলে হয়! পরে পরে পিসিমনিরও আসা বন্ধ, একই কারণে। পরম্পরা এভাবেই
বয়ে যায়, বয়ে যাবেও। ছেলে এখন কোলকাতার পুজো ছেড়ে যেতে চায় না, পাড়াতেই কত মজা, কুশলেরও একই বক্তব্য
"তুমি গেলে যাও, আমি ঐ বিজয়ার পর "।সে কারণে
পুজোতে আর যাওয়া হয় না।
বাসে ট্রামে সর্বত্র এখন পুজো
কেন্দ্রিক যে আলোচনা কান পাতলে কত উদার মহান মানসিকতারই না
পরিচয় মেলে! এত এত টাকার শ্রাদ্ধ, এই টাকায় দুঃস্থদের কত উপকার করা যায়......তো, ওঃ ঐ কয়েকদিন তো বাড়ি থাকাই
দায় আর তারপরেই কেনাকাটা সারা? এবার, কোথায়? সুমেধা শান্ত মনে শোনে টুকরো
কথার কথকতা, একেকসময় সহমতও হয় আবার যখন অন্যদিক থেকে ভাবে
মনে হয় এই পুজো তো কত লোকের অন্নসংস্থানেরও অঙ্গন। বিভিন্ন সম্প্রদায়, বিভিন্ন জেলা, রাজ্যের মানুষ আসেন, তাঁদের সৌজন্যে অসামান্য হয় এই উৎসব, ছাড়িয়ে যায় সব উৎসবকে।
আর্থিক অনটন কিছুটা তো সামলাতে পারে। সম্বৎসর অপেক্ষা, কাজের। দুটো পয়সার মুখ দেখার
তবে! সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষ জড়িত থাকে, তাইতো সর্বজনীন এই পুজো, দুর্গাপুজো। আর এত যে বিতর্কে
মেতে আছে তারাই তো পুজোর পর গর্ব করে বলে বিশেষ বিশেষ কোন্ পুজো দেখেছে, অমুকের সৌজন্যে পাস পেয়ে লাইন দিতে হয়নি। আরে ওটা
দেখোনি, অসাধারণ....কত কথা। কোনটা সঠিক, গুলিয়ে যায় সব। পুজোর আগে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, ফেসবুকে "তোমার
দুর্গা..... আমার দুর্গা...."-কোথায় !!! কোন্ প্যান্ডেলে কখন, কোথায় জমিয়ে খাওয়া এসবেরই
তো টানা ছবির মিছিল। সুমেধা এ চার পাঁচদিন মানুষ একটু আনন্দে
থাকুক, মিলেমিশে হাসিখুশিতে দিন কাটাক এই চায়, যে সব সমস্যার কথা তুলে ধরে
সেগুলো অযৌক্তিক নয় তবে সমাধানও যে কোথায় লুকিয়ে! হাজরা, হাজরা শুনে ঘোর ভাঙ্গলো সুমেধার, তড়িঘড়ি বাস থেকে নেমে হাতের কাঁধের ব্যাগ
সামলাতে সামলাতে বাড়ি ঢুকতেই বুতান দৌড়ে এলো "মাম্মা"
-“হ্যাঁ বাবু,এই তো সোনা”-কাছে টেনে নেয় সুমেধা। সারাদিন
এখন আর বাড়ি থাকে না বুতানও তবু স্কুল থেকে ফিরে মায়ের কোলের
অপেক্ষায় থাকে।
-“সব পড়া পেরেছিলে ?”
-“হ্যাঁআআ, আমার ক্যাডবেরীইই”
-“না, রোজ রোজ না বাবু, এই দেখো তোমার জন্য কি
এনেছি....”
-“মেধা, বিজুর মা আসবেনা এবেলা। চায়ের
কাপ হাতে শ্বাশুড়ি, নাও ধরো বলে কাপটা এগিয়ে দেন।“
-“একি!! মা তুমি এনেছো কেন!!”
-“সেতো তোমার শ্বশুরের জন্য করতেই
হয়েছে, নাও।“
হাত বাড়িয়ে চা নিতে নিতে
ভিতরে ভিতরে ক্ষোভে মনে হলো উফফ্, ভালো লাগে!!
-“কেন কিছু বলেছে ?”
-“বিজু এসে বলে গেল ওদের কে মারা
গেছে, মা আসবে না।“
বুতানের হোমওয়ার্ক, রাতের ব্যবস্থা করতে করতে যখন
ছুটি পেলো তখন ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে পড়তে চাইছে। বুতানকে মা খাইয়ে
দাইয়ে শুতে পাঠালে কি হবে তখন তো সে বাবাকে পেয়ে গেছে অতএব
চলছে বাবা-ছেলের আবোল তাবোল বকবকানি। ধমক দিয়ে শুইয়ে নিজের পরবর্তী কাজ আগামী
দিনের প্রস্তুতি, কুশল বলে "কি ম্যাডাম, মেজাজ কোন্ স্তরে"!!
-“যে স্তরেই থাক্ তোমার কি”
-“আমারই তো সব। আরে ফোন করে বলতে
তো পারতে, খাবার প্যাক করিয়ে আনতাম আসার সময়।“
-“বাবার শরীর ভালো না আর তুমি
বলছো বাইরের খাবার....”
-“আরে আজ তো কলেজ থেকে সোজা বাড়ি
আসোনি তাই বললাম।“
-“কি করবো, এইভাবে না করলে হবে? দিতে তো হবে সবাইকে। একটু একটু
করে কিনে রাখছি।“
-“হ্যাঁ এবার শুরু হবে দিতে
যাওয়া।“
-“তো! এতো করতেই হয়, সবাই করে। আজ আর বের করে দেখার
সুযোগও পেলাম না।“
-“তোমাদের এই আদান-প্রদান এবার
টাকায় কনভার্ট করোনা না, যে যার পছন্দ মতো কিনে নেবে।“
-“কি যে বলো!! সারাবছরে একবার।
পছন্দমতো তো সবাই কিনি কিন্তু এই পুজোর সময় পেতে যেমন ভালো লাগে দিতেও তো
আর পরস্পর পরস্পরের সাথে দেখাসাক্ষাৎ সেটাও হয়, এরও তো প্রয়োজন আছে তাই না !!”
-“ওক্বে ম্যাম্ লেকচার থাক্
তোমার উপরে বাড়তি চাপ পড়ে তাই বলছিলাম।“
সকালে বিজুর মা এলো, বিধ্বস্ত। জানা গেল ওর পাশে যে পরিবারের বাস তার কর্তাটি মহান
কাজ করেছেন ; নেশার ঘোরে মারধোর করে একান্ত নিজস্ব স্ত্রী-ধনটিকে, কাল কিঞ্চিৎ বেশি হয়ে যাওয়ায়
বউটি মুক্তি পেয়ে গেছে, দুব্বল সহনশক্তি ধকল নিতে পারেনি।
পুলিশ এসে কর্তব্য সেরেছেন অতএব তিনি এখন শ্রীঘরে। তিনটে সন্তান অসহায়, পড়শিরা সহায়ক তবে তাঁদেরই বা
কতটুকু ক্ষমতা। দাঁড়িয়ে শোনারও সময় নেই, সুমেধা বেরিয়ে পড়ে। মায়ের
আগমনী আবহে আকাশে বাতাসে ভেসে যায় নিত্যদিনের কত না
চাওয়া-পাওয়া। বিজুদের সমস্যা চাপা পড়ে যায়, সুমেধারও নানান অবশ্যপালনীয় কর্তব্যে মনে
থাকে না।
সবার জন্য যাহোক করে সব সামলানো
গেছে, বিজুর মা'রটাই বাকী আর কিছু টুকিটাকি। তৈরি
হয়ে বেরোনোর সময় সুমেধা বলে "মাসী, এবার কি কিনবো তোমার জন্য, বললে নাতো"। বিজুর মা পাঁচ
বাড়িতে কাজ করে, সব বাড়ি থেকে নিজের জন্য কাপড় না নিয়ে দুই-তিন বাড়ি
থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নেয়। আগে থেকেই বলেও রাখে সেকারণে।
-“বিছানার চাদর তো ১লাবৈশাখে নিলে, শাড়ি কিনি ?”
-“বৌমা, একটা কথা বলবো??”
-“হ্যাঁ বলো না”
-“আমি পুজোতে কিছু নেবো না গো।“
-“মানে ?? কেনো???”
-“আমার যা দরকার সেতো আমাকে বললেই
দাও।“
-“তো ! তার সাথে পুজোর কি সম্পর্ক, আর সবসময় তো নতুন দিইও না”
-“না গো, তোমাদের জন্য আমার কত যে সুরাহা
হয়.....”
-“ওঃ মাসী আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে
তো, বলো কি বলবে বলছিলে “
-“আমাকে এবার টাকা দেবে ?”
-“ওওও, হ্যাঁ কেন দেবো না, ভালোই তো তুমি পছন্দমাফিক যা
দরকার কিনে নিও।“
-“না বৌমা, এ টাকাটা ঐ বাচ্চাগুলোর জন্য
চাইছি।সুমেধা প্রথমে বুঝতেই পারে না কাদের কথা বলছে।“
-“কাদের জন্য??”
-“ঐ যে মা'টাকে মেরে ফেললো না, এখন আজ এ ঘরে তো কাল ও ঘরে। তিন
তিনটে প্রাণীকে পোষেই বা কে! কোনো কোনো দিন আধপেটাও জোটে কি জোটে
না, দেখা যায় না বলতে বলতে বিজুর মা'র চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
আমার কিচ্ছুটি লাগবে না গো, ঐ টাকাকটা পেলে ওদের দুদিন পেটে ভাত তো
পড়বে, তাতেই আমার আনন্দ। পুজোগন্ডার দিনে .....”
সুমেধা স্তম্ভিত হয়ে যায়। যার সংসারে নিত্য অভাব তাঁর মাতৃহৃদয়ে বাৎসল্যের
প্রাচুর্য বিস্মিত করে। মায়ের আগমন সার্থক। মাসী আলাদা করে ওদের জন্য সাহায্য
চাইতেই পারতো তবে তাতে দেওয়ার আনন্দ পেতো না। পুজো। দুর্গা পুজো এভাবেই সবাইকে
মিলিয়ে দেয় আর তাই সবার মুখে "আসছে বছর আবার হবে, বলো দুগ্গা মাঈ কীইই জয়য়"
ধ্বনিত হয়, রণিত হয় হৃদয় থেকে হৃদয়ে।