অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Monday, August 28, 2017

শম্পা সান্যাল


জীবন জীবনের জন্য

Sketch  : Godhuli Roy, Photo : icwow, Collage: Swarup Chakraborty


অনেকদিন পর আজ শ্রীমতি বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। এখন বেরোতেই ইচ্ছা করে না। কি যে হয়েছে,রাজ‍্যের আলসেমি। কয়েকদিন ধরেই অর্কদের বাড়ি যাবে ভাবছে,আজ সেকারণেই বিকেলে বেড়িয়ে রাস্তায় পরিচিত দু-একজনের সাথে কুশল বিনিময়,ইত‍্যাদি বাক‍্যালাপে চলতে চলতে পৌঁছে গেল গন্তব‍্যে। একবার বেরোলে মন্দ লাগে না, আসলে হুটহাট করে বেরোবার অভ‍্যাস‌ই নেই।


 অর্ক সাইকেল নিয়ে গেট খুলে বেরোতে গিয়েই শ্রীমতিকে দেখে ভিতর দিকে ফিরে চ‍্যাঁচালো 
"মা, কাকীমা এসেছেন"। 
"আড্ডা দিতে যাচ্ছিস" সহাস‍্য প্রশ্ন শ্রীমতির।
না,কাকীমা। হায়ার সেকেন্ডারির পর সব ছড়িয়ে গেছি, আর রোজ দেখা হয়না বন্ধুদের সাথে। রাতুলের কি খবর ? এত ব‍্যস্ত যে একটুও যোগাযোগ করেনা!
বলবো, তোদের ব‍্যাপার তো!! 
হাসতে হাসতে বলার মাঝে অর্কর মা কাকলির সহাস‍্য আমন্ত্রণ 
" এসো, এসো-বাব্বা, মনে পড়েছে তাহলে! এসো, ভিতরে এসো"।
মা, কাকীমা বেরোলাম।
আয়, কাকলি ,তাড়াতাড়ি ফিরবি;ততক্ষণে অর্ক চোখের বাইরে।


  গেট দিয়ে ঢুকেই শ্রীমতির ব‍্যাকুল চোখ চলে গেল স্বর্ণচাঁপা গাছের দিকে, সেদিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো "তোমার তো খুব মনে পড়ে"। কাকলি আবারও বললো "এসো, ভিতরে এসো "।আজ শনিবার,অর্কর বাবা বাইরের ঘরে বসা, ঢুকতেই স্মিত হাসলেন। ভদ্রলোক রাশভারী নন, মৃদুভাষী। নানান সামাজিক কাজে ব‍্যস্ত থাকেন কিন্তু দেখা হলে মৃদুহাসি উপহার দিতে ভোলেন না। কাকলি ওকে ডাইনিং-এ এনে বসালো।ফ‍্যানটা খুলে দিয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে বললো "আমার তো আর শনি-রবি নেই, আমার সৌভাগ্য আজ উনি বাড়ি আছেন "। শ্রীমতি ঈষৎ হেসে বললো "ইসস্, তবে তো ভুল দিনে এসে পড়েছি। এমন নিভৃতালাপের সুযোগ-" কাকলি হো হো করে হেসে বললো "ঠিক বলেছো, খুব অন্যায় করেছো-এখুনি বাবু বের হবেন বুঝেছো!!!! দাঁড়াও, চা টা দিয়ে আসি "।


 চা নিয়ে দুই বান্ধবী ডাইনিং হলেই বসলো।  স্ন‍্যাক্স ,কুকিজে সাজানো প্লেট, চা সামনে সাজিয়ে কাকলি বসলো পাশে এসে। শ্রীমতি দেখে আঁতকে উঠে বললো " পাগল, এতসব ...",  কাকলি মৃদু ধমক দিয়ে বলল "খাওতো। এবার বলো ...."বলেই " এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো - ভালো লাগে না আর। এ বাড়ির কেয়ারটেকার, এ আসছে,ও যাচ্ছে সারাক্ষণ শুধু ...., শ্রীমতি মনে মনে হাসলো, গৃহবধূদের নির্ধারিত জীবন পঞ্জী। মুখে বললো " তোমার তো তাও রাতে একা থাকতে হয় না। সেভাবে হিসাব করলে আমার তো অর্ধেকটা সময় একাই কাটলো!!"
-দাদা এখনও বাইরে যান ?
-আগের থেকে কম, এত কাজের চাপ! বাড়ি থাকলেও ফোনে বকে চলেছে, নিজেদের দরকারী কথাও বলতে পারি না- বলেই হাসতে হাসতে বলে " জানোতো , দাদাকে বলেছি তুমি বাইরে থাকলেই ভালো।
-কেনো!!! কাকলির বিস্ময়-তাড়িত কৌতুহল।
-বাইরে থাকলে তোমার দাদা নিয়ম করে দু-বার ফোন করবেই, বাড়ির চেয়ে বিদেশে থাকলে কথা বলার সুযোগ পাই তাই "। দুই বন্ধু হাসতে থাকে। শ্রীমতির মন চঞ্চল, বলে চলো, বাইরে যাই।
-এখুনি যাবে নাকি !!
-না, একটু গাছটার কাছে যাবো।
-ওওও, মেয়ের সাথে দেখা করবে, বলে কাকলি হাসে।


 স্বর্ণচাঁপা। গাছটা টবে প্রায় তিন বছর ছিল। গাছের নেশা শ্রীমতি ও ওর স্বামীর দুজনেরই। ছাদেই শখ মেটায়,  গাছটা মাটিতে লাগানোর কথা সুদীপ বলতো কিন্তু জায়গা কোথায়!  বাড়ির সামনে পিছনে যেটুকু জায়গা তাতে পেঁপে, পেয়ারা ইত‍্যাদি প্রথম প্রথম লাগিয়েছিল, ফল হলো এই ফলন্ত গাছগুলো কাটা গেল।আত্মীয়-বিয়োগ সম।একটা গাছ যখন উপকার করে তখন সে পারিপার্শ্বিকের সহায়ক কিন্তু অবুঝ গাছ যখন পাতা ঝরায় তার সীমাবদ্ধতা মানে না,তখন সে প্রতিবেশীর প্রতিবন্ধক স্বরূপ আর তাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য অগত‍্যা বৃক্ষ-ছেদন।একটা সরু লিকলিকে নিমগাছ ছাড়া দিয়ে উঠেছে, সঙ্কুচিতের মতো ঝিরঝিরে পাতাসহ নয়নাভিরাম গাছটিকে জানেনা বাঁচাতে পারবে কিনা। চাঁপা গাছটিকে বনসাই করার কথা কেউ কেউ বলেছিলো, তাতেও শ্রীমতির সায় নেই। বনসাই করতে সে জানেও না, ভালোও লাগেনা। চারিদিকে মানসিক সংকীর্ণতা, উদারতার এমনিই অভাব। বামন প্রকৃতির কালো ছায়া সর্বত্র, তার উপরে এক মহীরুহকে যত‌ই দক্ষতা থাক বনসাই রূপ দিতে মোটেও মন চায় না।সহজ স্বাভাবিক ভাবে যে বেড়ে ওঠে তার প্রকৃতিও সহজ,সরল হয়। যাই হোক, কাকলিকে কথায় কথায় একদিন গল্প করাতে ও বলেছিল ওর বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটাতে ইচ্ছে হলে লাগাতে পারে। শ্রীমতি খুশি হয়েছিল, ওর বাড়িতে না হোক্ ধরাতলে কোথাও তো আশ্রয় মিলবে, ছড়িয়ে দিতে পারবে ওর শাখা-প্রশাখা-
, গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করবে ওর শিকড় আর ওর সুবাসে আনন্দে ভরিয়ে দেবে আশপাশ।


 তাই একদিন অর্কদের বাড়ির সামনে গাছটা লাগিয়ে দিয়েছিল, মাটি মাতৃস্নেহে আশ্রয় দিলে গাছটি যেন প্রাণ পেলো, তরতর করে তার পিছিয়ে পড়াকে এগিয়ে নিয়ে গেল। অর্ক এরমধ‍্যে একদিন গিয়ে বলে এসেছিল কাকীমা তোমার গাছে ফুল ফুটেছে, মা যেতে বলেছেন। সেই থেকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছিল। কথা বলতে বলতে দুজনে এসে গাছটার পাশে এসে দাঁড়াল।সন্ধ‍্যে হয়ে এসেছে, গাছটা নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে যেন চাপা অভিমানে বলতে চাইছে এতক্ষণে আমার কথা মনে পড়লো! আস্তে আস্তে গাছটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে শ্রীমতি বললো তোমরা ওকে প্রাণ দিয়েছো। কাকলি হাসে,সহাস‍্য মন্তব্য করে সেটা ঘ্রাণে বুঝতে পারি। জানো, পথ চলতি অনেকেই দেখি গাছটার দিকে তাকিয়ে। নীচে একটা মলিন ফুল কুড়িয়ে নিতে নিতে বলে "ফুল তোলো"?
ঐ দুটো চারটে তুলি কখন‌ও। শ্রীমতি ভাবে স্বর্ণচাঁপা ফুলের গোড়া বেশ শক্ত। মনে মনে বলে "রাগ করিস না মা। দৃঢ়তার সাথে বেঁচে থাক্। মেয়েরা পরের বাড়ি যাবার জন‍্য‌ই  তো আসে। এভাবেই চারিপাশ সুন্দর করে, আলো করে রাখ্ মা! তোরা ভালো থাকলে তবেই তো আমাদের বেঁচে সুখ। ফুলে-ফলে সবুজের সমারোহেই তো রয়েছে মানব জীবনের সুস্থতার বার্তা। হঠাৎ মৃদু হাওয়ায় দুলে ওঠে পাতাগুলো, যেন বলতে চায় তোমরা ভালবাসলে আমরা নিশ্চয়ই এই উষ্ণ পরিবেশে আনতে পারবো শীতলতার ছোঁয়া।

ভালো থাকবো সবাই।

Monday, July 31, 2017

স্বরূপ চক্রবর্তী




কালো বাঁশ








(১)
রাত্রি প্রায় সোয়া দশটা,ঝম ঝমে বৃষ্টিতে সামনের পিচের রাস্তার মাত্র কয়েক ফুট দূর অব্দি দেখা যাচ্ছে,হেলমেটের সামনের কাঁচটা বার বার আবছা হয়ে আসছে-
কিন্ত, কিছু করার নেই, রবীন নিরুপায়, কারণ তাকে যে আজ রাত্রের মধ্যেই যে করেই হোক ত্রিশ কিলোমিটার দুরের রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছতেই হবে, মা অসুস্থ......,

নানা ভাবনার মধ্যেই রবীন খেয়াল করলো যে সামনের রাস্তাটা হঠাৎ একটা দ্বিধাবিভক্ত মোড়ে এসে শেষ হ, ডান দিকে গেলে স্টেশন আর প্রায় পঁচিশ কিলোমিটারের রাস্তা, রাস্তা ভাল,মাঝে মধ্যে জনবসতিও আছে,  বাম দিকের রাস্তাটি বেশ ছোট,স্টেশন প্রায় দশ কিলোমিটার, কিন্তু একেবারে ফাঁকা , মাঝে পড়বে কালবনির শাল জঙ্গল, এমনিতে কোনও ভয় নেই , তবে ঝড়- বৃষ্টির দাপটে এক আধটা গাছ হয়ত পড়ে থাকলেও থাকতে পারে, তবে, রবীন শুনেছে যে শাল গাছ খুব শক্ত হয়, সহজে ভাঙেনা, সেটা নিয়ে নয়, তার চিন্তা একটা অন্য কারনে......

এখানে সে এসেছিল বন্ধুর বাড়িতে, উচ্যমাধ্যমিকের পর ছুটি কাটাতে, বন্ধু শুভেন্দু ও তার পরিবার সবাই মিলে তার ভীষন যত্ন করেছে, গ্রামের বাড়ী, কিন্তু স্বচ্ছল পরিবারের সমস্ত চিহ্ন বিদ্যমান, এই গ্রামে এখনও শহুরে রাজ নীতির ঘোলা জল ঢোকেনি, ফলে গ্রামের সকলের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় আছে, পুকুরে প্রচুর মাছ, গাছে গাছে আম, কাঁঠাল, লিচু- এক্কেবারে স্বর্গরাজ্য। রবীনের বেশ ভালো লাগছিলো , কিন্তু , একটা ব্যাপার মানতে প্রথম প্রথম তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল, সেটা হল যে গ্রামের সবাই, এমন কি শুভেন্দুরা, যারা কিনা উচ্চ শিক্ষিত, বাড়িতে নিয়মিত পত্র পত্রিকা আসে, টেলিভিশন, ল্যাপটপ, মায় আন্ড্রয়েড মোবাইল পর্যন্ত ব্যবহার করে , তারা সবাই এখনও অলৌকিক ব্যাপারে ভীষণ বিশ্বাস করে।
ওদের সবার মধ্যে একটাই আতঙ্কের জায়গা, সেটা হল কালবনির জঙ্গল ও তার মধ্যের নীল কুঠি, ওদের বিশ্বাস যে সেখানে নাকি এখনও অলৌকিক কাণ্ডকারখানা ঘটে। তাই, গ্রাম থেকে মাত্র পাঁচ ছয় কিলোমিটার দূরের ওই জঙ্গলে পারত পক্ষে কেউই যায়না।
বিজ্ঞানের ছাত্র রবীন ভুত-প্রেতে কিছুটা কম বিশ্বাস করে, তাই সপ্তাহ খানেকের রাজকীয় সেবাতে ,তার মাথার মধ্যে থেকে ভয় , ভাবনা সব হাওয়া হয়ে গিয়েছিল।

আজ বিকালে হঠাৎ ফোন, তার মায়ের ভীষণ অসুখ, তাকে আজই যে করে হোক বাড়ী ফিরতেই হবে। কিন্তু এখন তো তাকে শীঘ্রই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতেই হবে, “ডানদিক ? না বামদিক? কারন বৃষ্টি থামার কোনই লক্ষণ নেই, এদিকে রাত একটা দশের ট্রেনটা ধরা ভীষণ জরুরী, তবেই সে কাল ভোর নাগাদ বাড়ি পৌঁছতে পারবে, কে জানে মা কেমন আছেন?.................................

(২)

এই পর্যন্ত পড়ে বিমল বাবু  থামলেন,
সামনের টেবিলে রাখা ঢাকনা দেওয়া গেলাস থেকে জল নিয়ে একটু গলাটা ভিজিয়ে নিলেন, তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলেন ওপারে বসা, রাশভারি ভদ্রলোকের দিকেভদ্রলোক পাক্ষিক কালো বাঁশপত্রিকার সম্পাদক, পত্রিকার এই রকম অদ্ভুত নাম করণের কারণ জানতে চেয়েছিলেন বিমল বাবু তার একান্ত অনুগত ভক্ত শ্রীমান বটুক সরখেলের কাছ থেকে, বটুক ওই পত্রিকায় ডি.টি.পির কাজ করে, বিমল বাবুর পাড়াতেই থাকে, অকৃতদার, রিটায়ার্ড সরকারি চাকুরে বিমল বাবু একটু আধটু লেখা লিখি করতে ভালো বাসেন, তাঁর লেখা তিনি পাঠান বিভিন্ন  অন লাইন পত্র পত্রিকায় বা তার নিজের ফেস বুক ওয়ালেপোষ্ট করেন , বেশ লাইক আর কমেন্ট পান, কিন্তু তাতে তাঁর মন ভরেনা, তিনি ছাপার অক্ষরে নিজের নামটা দেখতে চান, তাই পত্রিকা অফিসে কাজ করে শুনে তিনি বটুকের সাথে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেন, বটুকও মাঝে মাঝে  চা এবং সাথে  টাএর লোভে বিমল বাবুর বাড়ীতে হানা দেয়।

তা, একদিন সুযোগ বুঝে বিমল বাবু বটুকের কাছে টুক করে কথাটা পেড়েই ফেললেন।

-বাবা বটুক তুমি তো পত্রিকা অফিসে কাজ করো তাই না ?”

উত্তরে বটুক একমুঠো ডালমুট মুখে চালান করে বলল

-কালো বাঁশ

উত্তর শুনে আবলুশ কালো ক্ষীণকায় বিমল বাবু থতিয়ে গেলেন, ভাবলেন

-আমাকে কালো বাঁশ বলল?”

তাঁর মুখের করুণ অবস্থা বুঝে বটুক মুখের ডালমুট গুলো ম্যানেজ করে বলল,

-কিছু মনে করবেন না মেসোমশাই , ওটা আমাদের পত্রিকার নাম

-ওহ্‌ তাই”, হাঁফ ছাড়লেন বিমল বাবু।

বটুক বলে চলল,

-আমাদের পত্রিকার সম্পাদক  নিত্যনতুন গড়গড়ি মশাই ভীষণ এলেমদার লোক, সাহিত্যের সমঝদার, তিনি বলেন যে আমাদের পত্রিকায় এমন লেখা ছাপাব যে সব ব্যাটা কে একেবারে বাঁশ দিয়ে ছাড়ব

-বাঁশ বুঝলাম কিন্তু কালো কেন?”, বিমল বাবুর জিজ্ঞাসা,

-কারণ লাল, সবুজ, গেরুয়া, সমস্ত রঙ গুলোরই কপি রাইট নেওয়া হয়ে গেছে, তাই কালো

–“ আর তা ছাড়া এই নামটির মধ্যে একটি গভীর শ্লেষ আছে, ঠিক জায়গায় লাগলে একেবারে বাঁশের বাড়ির মতোই লাগবে”, বটুকের মুখে একটি কালজাম অদৃশ্য হয়ে গেলো।

বিমল বাবু একটু দমে গেলেন, ভাবলেন -এই রকম প্রগতি শীল পত্রিকায় কি তাঁর মতো সাধারণ অনামি লেখকের লেখা ছাপাবে?”

বটুক আস্বস্ত করল, বলল,

-ভয় নেই মেসোমশাই, আমাদের সম্পাদক মশাই নিজে আধুনিক কবিতা লেখেন এবং অরিজিন্যাল লেখা খোঁজেন, ভালো হলে অবিশ্যি ছাপবেন”,

-আর তা ছাড়া ওঁনার পরিবারের সঙ্গে আমার একটু ইয়ে আছে”, বলে বটুক তার পান খাওয়া ক্ষয়াটে দাঁত দেখিয়ে হাসল।

-ইয়ে?” বিমল বাবুর অধীর জিজ্ঞাসা।

-বৌদি, মানে  নিত্যনতুন গড়গড়ি মশাইএর বউ এর সমস্ত ফাই ফরমাশ তো আমিই খাটি,
চাকরির যা বাজার, কোনোও ক্রমে স্কুল ফাইন্যাল টা পাশ দিতেই বাবা চোখ ওলটালেন, আর আমাদের গনেশও ওলটাল, ডি.টি.পি. টা শিখে চাকরি করছি”,

-বুঝলেন তো?”

বিমল বাবু সব বুঝেছেন।
(৩)

সেই মতো আজ  ১০ই চৈত্র তিনি কালো বাঁশপত্রিকার দফতরে সম্পাদক মশাই কে তাঁর গল্পটা পড়ে শোনাচ্ছিলেন, মনে হয় ওঁর ভালোই লাগছিলো, কিন্তু একটা ব্যাপারে খটকা হচ্ছিল বিমল বাবুর, সেটা হল যে তাঁর রোমহর্ষণ কারী রহস্য গল্পের মধ্যে হাসির খোরাক কথায় পেলেন জানেন না কিন্তু চোখ বুঁজে গল্প শুনতে শুনতে নিত্যনতুন গড়গড়ি মশাই তাঁর জালার মতশরীর টা দুলিয়ে দুলিয়ে মৃদুমন্দ হাসছিলেন।

বিমল বাবু নিজেকে বোঝালেন ,

-এলেমদার আধুনিক কবি, গভীর চিন্তায় মগ্ন, হয়ত বা তাঁর ব্রেনটাই দুভাগে ভাগ হয়ে এক সাথে দুই রকম কাজ করছে, একটা অফিসে বসে যশপ্রাথী নবীন লেখকের লেখা গল্প শুনছে, আর অন্য পাশটা হয়ত কাউকে বাঁশ দেওয়া টাইপ কোন আধুনিক কবিতার পঙতি ভাবছে, বাবাঃ, কি প্রতিভা

কিন্তু সন্দেহ যায়না, তাই সন্দেহ নিরসন করতে বিমল বাবু গল্প পড়া থামালেন,  ওই সেই যেখানে রবীনের সামনে দুটো রাস্তা খোলা।

-বাঃ, বেড়ে হয়েছে”, ঢাকাই জালার ভেতর থেকে গমগমে আওয়াজ বেরোল, “ থামলেন কেন? চালিয়ে যান !

বিমল বাবু খুশি হয়ে বাকিটা পড়তে যাবেন , এমন সময় গড়গড়ি বাবু হাত তুলে ওনাকে থামালেন,

-গল্পটা অরিজিন্যাল তো?”

-নিশ্চয়ই

-আর কে কে শুনেছে?”

-কেউ না, কেবল মাত্র বটুক, আর আপনি এই অর্ধেক টা।

-যাক, তাহলে ওটা রেখে যান”, বাঁজ খাঁই গলায় বললেন সম্পাদক।

-ওটা আমি নিজে পরে পড়ে নেবখন ”  পানের ডিবে থেকে মুখে একটি বিশাল পান ফেলে বললেন,

-তবে কি জানেন ময়ায় ? লেখাটা খুবই শিশু সুলভ, ওতে সামান্য ঘষা মাজা করতে হবে, সে আমি করে নেবখন, ইয়োর স্টোরি হ্যাজ বিন সিলেক্টেড, আপনি এখন আসতে পারেন

(৪)

আজ ১লা বৈশাখ, আজই তো কালো বাঁশ পত্রিকার নববর্ষ সংখ্যার প্রকাশের দিন,
উত্তেজনায় বিমল বাবুর ঘুম হয়নি গত রাত্রে, স্বল্পে সন্তুষ্ট বিমল বাবু সংসার করেন নি বলে কোনও ঝক্কি ঝামেলা বা টেনশন পোহানোর অভিজ্ঞতা তেমন নেই বললেই চলে,
তাঁর নিস্তরঙ্গ জীবনে এত ঢেউ উঠবে তিনি কি কখনও ভেবে ছিলেন? মনে হয় না।
প্রথম বার ছাপার অক্ষরে তাঁর নাম শুধু নয় , মায় একটা আস্ত লেখা ছাপতে চলেছে, তাও আবার কালো বাঁশএর মতো স্বনামধন্য পত্রিকায়,

উফফ্‌, গায়ে কাঁটা, আর চোখে লঙ্কাবাটা।

নামের বানান টা যেন আবার ঠিক ঠাক ছাপে, বটুক কে তিনি পই পই করে সাবধান করে দিয়েছেন,

-বাবা বটুক, তুমিই ভরসা, দেখো  ডি.টি.পি.তে কম্পোজ করার সময় আমার নামের বানান টা যেন ঠিক থাকে,”
(৫)

সেই মতো মোড়ের দোকানের জলভরা’, ‘রাবণের মাথার সাইজের রসগোল্লা’, ‘সিঙ্গাড়া’, আর বটুকের প্রিয় ডালমুট, সব কিছু সকাল হতেই তিনি তাঁর কাজের লোকের হাতে আনিয়ে সাজিয়ে একেবারে প্রস্তুত।

ঠিক সাড়ে নটা, “রিইইইইইইং করে ডোর বেলটা বেজে উঠল, যেন বেল নয় কোনও মহান ঘটনা ঘটার আগের শঙ্খনাদ, আঃ, ডোর বেল টা এত মধুর কোনও দিন শোনায় নি।

দরজা খুলতেই বটুক হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকল,

-এই নিন মেসোমশাই”,

বলে এক খানা পাকানো কালো বাঁশবিমল বাবুর হাতে গুঁজে দিয়েই, খাবার প্লেটে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাবণ বধেমন দিল।

-চৌত্রিশ নম্বর পাতাটা খুলুন”, মুখের রসগোল্লা ম্যানেজ করতে করতে বলল বটুক।

কম্পমান হাতে চৌত্রিশ নম্বর পাতাটা খুলে বিমল বাবুর নয়ন সার্থক হল।
এইত, তাঁর লেখা গল্পটি দেখা যাচ্ছে, সুদৃশ্য হরফে, ঝক ঝকে কালিতে, পুলকে কেঁপে উঠল তাঁর মন, তড়ি ঘড়ি গল্পের শেষে তাঁর নামটি দেখতে গিয়ে চক্ষু ছানাবড়া, আরে! লেখকের নামের জায়গায় তাঁর নামের বদলে এটা কার নাম লেখা?
বার তিনেক চোখ ঘষার পরও নামটা সেই একই আছে, বিমল চন্দ্র বড়াল এর জায়গায় শ্রীমতি নবীনা গড়গড়ি”, বিমল বাবু রক্ত চক্ষু করে বটুক কে বললেন,
-এটা কি হল’”

-বাঁশ। কালো বাঁশ”, অম্লান বদনে বলল বটুক।



-মানে?” বিমল বাবু রাগে অগ্নিশর্মা।


এক সাথে দুটো জলভরা মুখে চালান করে দিয়ে বটুক বিস্তারিত বলে চলল...

-আসলে সম্পাদক মশাই বললেন যে আপনার লেখাটা একেবারে অপরিনত, কাঁচা,
ওতে বর্তমান আর্থসামাজিক তথা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এর বর্ণনা ও তার  বিশ্লেষণ   মিসিং , একেবারে যা তা, তাই ওটাকে অনেক শুধরাতে হয়েছে, একটা মুখবন্ধও উনি লিখে দিয়েছেন, এই দেখুন,

-উনি লিখেছেন যে”,

-এটা একটা পথভ্রষ্ট যুবকের গল্প, যে দ্বিধাতে আছে যে তার কোন আদর্শের সাথে যাওয়া উচিত, ডান নাকি বাম,.........ইত্যাদি ইত্যাদি



-আর আমি তো বলেইছি যে উনি অরিজিন্যালিটি তে বিশ্বাস করেন, তাই বললেন, যে এত কিছু যখন ওনাকে লিখতে এবং বদল করতে হলতখন লেখাটি তো এক প্রকার ওঁরই,”

-হেঁ হেঁ বটুক লেখাটি তুমি বরং তোমার বউদির নামের ছাপিয়ে দাও, সম্পাদকের গিন্নি বলে কথা, সমাজে মুখ দেখাতে হলেওনারও তো কিছু সাহিত্য কর্ম থাকা উচিৎ, কি বল বটুক, ঠিক কি না”?

-আর মেসোমশাই আপনি আর কি বুঝবেন, আমার বিশাল সংসার টা তো আমারই ঘাড়ে, চাকরির যা বাজার






(৬)

বিমল বাবু লেখা ছেড়ে দিয়ে এখন বাড়ির পিছনে একফালি জমিতে মন দিয়ে বাগান করছেন।ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখছেন যে নিজের বাগানে বাঁশফলানো যায় কি না,


তা হলে এক খানি সরেস বাঁশ তিনি নিত্য নতুন গড়গড়ি কেপাঠিয়ে দেবেন।।




Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান