অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Showing posts with label Seventh Year First Issue. Show all posts
Showing posts with label Seventh Year First Issue. Show all posts

Saturday, April 13, 2024

গল্প - অংশ - তনিমা সাহা

 গল্প

  

অংশ

তনিমা সাহা

Image Source- Internet


 

নীলার আজ পরীক্ষার দিন জীবনে যতরকম পরীক্ষা দিয়েছে সেসব পরীক্ষা থেকেও সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এটা নাহ্! ভয় করছে না নীলার কিন্তু একদমই কী করছে না? বুকের ভেতরটায় একটু কিন্তু দুরুদুরু করছে ঠিকই কিন্তু এখন দুঃশ্চিন্তা করলে যে পরীক্ষা খারাপ হতে পারে! নাহ কিছুক্ষণ চোখটা বন্ধ করে নাহয় রাখা থাক

 

নীলা রে কী হ্যান্ডসাম একটা ছেলে দেখলাম রে!

 

ওফ্…প্রিয়া! তোর কী আর সারাদিনে কোন কাজ থাকে না?

 

না রে! আমি না তোর মতো অত বোরিং হতে পারলাম না 

 

শোন ওটাকে বোরিং বলে না অনেস্টি লয়েলিটি বলে বুঝলি

 

রাখ তোর অনেস্টি আর লয়েলিটি! কী হবে ও নিয়ে! আজকালের অনেস্টির মূল্যটা আমাদের পিওন দাদাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে নে ক্যামেস্ট্রিতে মাস্টার্স করেও পিওনের চাকরি করছে কেন? কারণ পঞ্চাশ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রফেসরের চাকরিটা কিনতে পিওন দাদার অনেস্টি আর লয়েলিটিতে আঘাত পড়েছিল এমন নয় যে আর্থিক ভাবে সে অসঙ্গত বাবার টাকা থাকা সত্ত্বেও নিজের অনেস্টি আর লয়ালিটির দম্ভে অতবড় বাড়ি ছেড়ে এসে শেষে এখানে পিওনের চাকরি করছে

 

কীইই! কিন্তু প্রিয়া তুই এই কথাটা কিভাবে জানলি?

 

হমহহ! নিজের দাদার সম্পর্কে তার মায়ের পেটের বোন জানবে না তো কে জানবে?

 

কিন্তু তোকে তো কখনও পিওন থাদার সাথে কথা বলতে দেখি নি!

 

দাদাই কথা বলে না বলে তার সাথে কথা বললে নাকি আমার সম্মান হানি হবে আজ তো দেখলাম একজন নতুন পিওন দাদা এসেছে হয়তো অস্বস্তি এড়াতে দাদা এখানকার চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছে জানিস যেদিন দাদা পিওনের চাকরিটা নিলো সেদিন থেকে বাবা দাদাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে কোনরকম যোগাযোগটুকুও ছিল না এখানেই দাদাকে প্রায় তিনবছর পর দেখলাম

 

নীলার মনে হয় দুনিয়াটা সত্যি বড় গোলমেলে তার জীবনেও কী সব সুস্থির আছে? হমহহহ! যদি স্কলারশিপটা সে না পেত তাহলে কী এই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্নটা সফল হত কখনও? পড়াশুনোয় ভাল নীলা কলেজের পড়ার খরচটা নিজের টিউশনের পয়সা দিয়েই করেছে নিজের বাড়িতে নীলার অবস্থান একটা উদ্বাস্তু ছাড়া আর কিছুই নয় বহুবার ভেবেছিল নীলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার কথা কিন্তু কোন নিশ্চিত আশ্রয়ের জোগাড় না করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা বোকামি! শেষে এই স্কলারশিপটা হাতে এল; যদি পি.এইচ.ডি.টা করে ফেলা যায় তাহলে একটা চাকরি অন্ততঃ নিশ্চিত ইউনিভার্সিটি এসে তাই নীলার একটাই ধ্যান-জ্ঞান পড়াশুনা পড়াশুনা আর পড়াশুনা প্রিয়ার বাবা তো বড়লোক! ইউভার্সিটি ভর্তি হয়েছে অনেক টাকা ডোনেশন দিয়ে হোস্টেলে প্রিয়া নীলার রুমমেট বড়লোক হলেও প্রিয়ার মধ্যে কোন অহংকার নেই নীলার সাথে প্রিয়ার যতই মন কষাকষি হোক না কেন দিনের শেষে সেই নীলাকেই তার সব কথা বলা চাই তাই নীলা প্রিয়ার বন্ধুত্বটাও একটা আলাদা পর্যায়ের

 

এই, এই দেখ নীলা! সেই হ্যান্ডসাম ছেলেটা! চল গিয়ে আলাপ করি

 

কথাটা বলে নীলার উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রায় তাকে টানতে ছেলেটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় প্রিয়া

 

হাই…আমি প্রিয়া সোসাল স্টাডি ডিপার্টমেন্ট আর তুমি?

 

হাই আমি কমলেশ ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট

 

হ্যালো আমি নীলা সংস্কৃত ডিপার্টমেন্ট

 

হাই নীলা বসো না তোমরা দাঁড়িয়ে কেন? কফি চলবে তো তোমাদের?

 

চলবে মানে…দৌড়ুবে(প্রিয়া)

 

আলাপটা ঠিক এভাবেই শুরু হয় পরিচয় পর্ব সমাধা হওয়ার পর তিনজনের মধ্যে সমীকরণটাও গাঢ় আঁচে জ্বাল হতে সময় নেয় না তিনজনের বন্ধুত্বটাও বাড়তে থাকে দিনে দিনে কমলেশদের বৃন্দাবনহাটিতে বিশাল পৈতৃক বাড়ি যদিও এখন ওখানে কেউ থাকেন না সবাই কাজের সূত্রে এদিক ওদিক থিতিয়েছেন শুধু দুর্গাপুজোর সময় সবাই একসাথে পৈতৃক ভিটায় কিছুদিন কাটিয়ে আসেন কমলেশের বাবা মা দুজনেই ডক্টর প্রসার প্রতিপত্তি ভালই তার সাথে বনেদিয়ানা ঠাটবাটও আছে সেবারের দুর্গাপুজোটা দুই বান্ধবী কমলেশের পৈতৃক বাড়িতেই কাটিয়েছিল প্রিয়া যেন দিব্যি সে পরিবেশে মানিয়ে যায় নীলার একটু অস্বস্তি হয় তার নিজেকে সেখানে বড্ড বেমানান লাগে 

পুজোর ছুটির পর কলেজ খুলে গেছে ছাত্রছাত্রীরা যারা বাড়ি গিয়েছিল সব ফিরে এসেছে নীলা জীবন থেকে 'বাড়ি' নামক জায়গা বেপাত্তা হয়ে গেছে ততদিনে বাড়ির লোক নীলার সাথে যোগাযোগ করতো না নীলাও আর আগ বাড়িয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতো না তাই পুজোর ছুটির যে'কদিন বাকি ছিল সেটা সে হোস্টেলেই কাটিয়েছে যদিও প্রিয়া অনেক জোরাজুরি করেছিল তার সাথে তার বাড়ি যাওয়ার জন্য কিন্তু নীলা আর নিজের অস্বস্তি বাড়াতে চায় নি 

 

মাস্টার্সের আর কয়েকদিন পরেই ফাইনাল সেমিস্টার প্রিয়া বিভিন্ন কলেজে পি.এইচ. ডি. করার জন্য অ্যাপ্লিকেশন করতে থাকে একদিন কলেজ থেকে হোস্টেলে ফেরার সময় ক্যান্টিনের ফাঁকা গলিটায় নীলা প্রিয়া আর কমলেশকে একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলতে দেখে প্রিয়ার বুকে কোথাও যেন চিনচিন করে ব্যথা হয় হঠাৎ ভীষণ শরীর খারাপ লাগতে শুরু হয় নীলার দরদর করে ঘামতে থাকে নীলা তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হোস্টেলে ঢুকে সোজা বাথরুমে গিয়ে হরহরিয়ে বমি করে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে নিজের রুমে এসে বিছানায় উপুর হয়ে বালিশে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে; যাতে বাইরে আওয়াজ না যাক কিছুক্ষণ পর প্রিয়া এসে দরজায় ধাক্কা দিলে নীলা বিছানা ছেড়ে উঠে নিজেকে সামলে দরজাটা খুলে দেয় দরজা খুলে নীলা বলে…

 

আরে কী ব্যাপার বেশ খুশি খুশি লাগছে দেখি মহারাণীকে

 

আমার কথা পরে হবে! আগে তুই বল তোর চোখমুখের এই দশা কেন? শরীর খারাপ লাগছে?

 

আরে না না এমনিতেই একটু টায়ার্ড হয়ে আছি তুই বল! হঠাৎ গালদুটো এত লালটুস লালটুস হয়ে গেছে কেন?

 

(লাজুক হেসে) কমলেশ আমাকে প্রপোজ করেছে

 

ওয়াও…ওয়ান্ডারফুল আর তুই কী বললি?

 

আমি 'হ্যাঁ' বলেছি

 

ওয়াহ..একটা তাহলে ফাটাফাটি বিয়ের নেমন্তন্ন পেতে চলেছি 

 

ধ্যাৎ তুই না…

 

প্রিয়ার খুশি খুশি মুখটা দেখে নীলা ভাবে, 'এটাই তো হওয়ার ছিল এটাই তো স্বাভাবিক আমি তো কোনদিনই সেখানে ছিলাম না সে জায়গাটা তো সবসময় প্রিয়ারই ছিল তাহলে…তাহলে কেন… আমার এত কষ্ট কেন হচ্ছে? কেন আমার সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে!'

 

মনের দোটানার অর্থ প্রিয়ার বোধগম্য হয় না দেখতে দেখতে মাস্টার্সের লাস্ট সেমেস্টারটাও শেষ হয় 

প্রিয়া জানায় যে কমলেশ পি.এইড. ডি. করতে বাইরে যাবে আর সে-ও ওই একই জায়গা থেকে পি.এইচ. ডি. করবে তাই বাড়ির লোক চাইছে তাদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দিতে 

খবরটা শুনতে শুনতে নীলা হঠাৎ থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করে কোনরকমে হাসির আড়ালে নিজের চোখের জলটা চেপে প্রিয়ার সামনে থেকে চলে আসে নীলা দুদিন পরেই প্রিয়া হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছিল একমাস পরই কমলেশ আর প্রিয়ার বিয়ে নাহ! নীলা যায় নি সে বিয়েতে বলা ভাল সে বিয়ে দেখার মতো মনোবল নীলা জুটিয়ে উঠতে পারে নি পি.এইচ.ডি.র পাশাপাশি চাকরির জন্যও চেষ্টা করছিল নীলা যেটা হাতে লাগে! প্রিয়া হোস্টেল ছাড়ার দিনই একটা চাকরির চিঠি পায় নীলা ব্যস! তারপরেই নীলা কমলেশ আর প্রিয়ার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে যায় দেখতে দেখতে জীবনেরও ঋতু পরিবর্তন হয়

 

কি গো সায়নী দি এত কী ভাবছো?

 

আমার এক পেশেন্ট আছে জানো তো! খুব ভাল মানুষ সব রিপোর্ট নর্মাল থাকা সত্ত্বেও পেশেন্টটি কনসিভ করতে পারছে না তাই সারোগ্যাসি করতে চায় কিন্তু সঠিক 'বার্থ মাদার' খুঁজে পাওয়াও যে মুসকিল!

 

পেশেন্টের নাম কী গো?

 

 

বত্রিশ বছরের নীলা এখন একজন স্কুল শিক্ষিকা এবং বিভিন্ন এ.জি.ও. র সাথে যুক্ত পি.এইচ.ডি.টা আর করা হয় নি তার বিয়েটাও করা হয় নি আসলে সেই একজনকেই তো পাশে চেয়েছিল সে সে-ই যখন….

এরপরের কাহিনী সোজা বহুদিন পরে প্রিয় বান্ধবীকে দেখে প্রিয়া আর কমলেশের অভিমান আর অনুযোগের বৃষ্টি অবিরত ঝরে পড়ে তবে নীলার প্রস্তাব শুনে প্রিয়া আর কমলেশ প্রথমে কিছুতেই রাজি হতে চায় নি

 

কিন্ত নীলা তাদের দুজনকে বুঝিয়ে বলে, 'আমি তো তোদের বন্ধু এক বন্ধুর ক্রাইসিসে আরেক বন্ধুকে কাছে থাকতে দে প্লিজ আমি তো তোদের বিয়েতে কোন উপহার দিতে পারি নি ভেবে নে না তোদের জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটা না হয় এই বন্ধু থেকেই পেলি'

 

কমলেশ আর প্রিয়া এরপর আর আপত্তি করে নি

 

ম্যাডাম চলুন 

 

হ্যাঁ চলুন সিস্টার

 

হাসপাতালের ম্যাটার্নিটি ডিপার্টমেন্টের কোনার কেবিনটায় সোফায় বসে নীলা পুরোনো কথাই মনে করছিল সিস্টারের ডাকে আবার সে বাস্তবে ফিরে আসে ছোট থেকে সব পরীক্ষাতেই নীলা সফলতার সঙ্গেই উত্তীর্ণ হয়েছে তার বিশ্বাস এই পরীক্ষাটাতেও সে উত্তীর্ণ হবে আধঘন্টা পরে ও.টি.র বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা উদ্বিগ্ন প্রিয়ার কোলে যখন ছোট্ট পরীটাকে দেওয়া হল তখন প্রিয়ার চোখের বাঁধ আর মানলো না

 

কমলেশ দেখো..দেখো..আমাদের সন্তান আমরা পেরেছি আমরা আমাদের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পেরেছি

 

হ্যাঁ, প্রিয়া

 

দুজনের চোখ বেয়ে বয়ে চলে আনন্দাশ্রু 

 

একটু সামলে কমলেশ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সিস্টারকে বলে, 'সিস্টার নীলা..নীলা কেমন আছে?'

 

সিস্টার হেসে বলেন, 'উনি একদম ঠিক আছেন স্যার তবে আমাদের মিষ্টি খাওয়ানোর ব্যাপারটা কিন্তু মাথায় রাখবেন'

 

কমলেশ হেসে বলে, 'নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই'

 

দেখতে দেখতে কেটে যায় দুমাস নীলা এখন কয়েকদিন প্রিয়ার কাছেই থাকছে খানিকটা প্রিয়ার জোরের জন্য আর খানিকটা… ছোট্ট পরীটা দেখতে অনেকটা নীলার মতো একদিন সকালে প্রিয়া নীলার রুমে এসে দেখে রুমে কেউ নেই বাইরেও কোথাও নেই নীলাকে ডাকতে ডাকতে প্রিয়া বাড়ির বাইরে পর্যন্ত খুঁজতে আসে নাহ্! কোথাও নেই নীলা হন্তদন্ত হয়ে প্রিয়া কমলেশকে ডাকতে আসে ঘরে ঢুকে দেখে কমলেশ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছোট্ট পরী তখন সারারাত পাহারা দিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন

 

শুনছো! নীলাকে কোথাও পাচ্ছি না

 

নীলা চলে গেছে প্রিয়া চিরতরে..

 

কমলেশ একটা ভাঁজ করা কাগজ প্রিয়ার হাতে ধরিয়ে দেয় যাতে লেখা ছিল, 

 

'ভাল থাকিস তোরা দুজনে

ভাল থাকিস দুজন আজীবনে'

               ইতি

         অভাগী নীলা

 

তুমি এটা কোথায় পেলে?

 

আমার মাথার বালিশের পাশে

 

কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর প্রিয়া বলে, ' নীলা তোমাকে খুব ভালবাসতো কমলেশ তাই হয়তো ভালবাসার মানুষটির জন্য সে নিজের প্রাণভোমরাকে দিয়ে দিতে এক বারের জন্যও ভাবে নি'

 

কমলেশ হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলে, 'সারাজীবন ধরে ভাল থাকার উপায় খুঁজতে খুঁজতে হয়তো ভাল থাকার আস্তানা শেষে খুঁজে পেয়েছে নীলা হয়তো সে তার অংশকে রেখে যেতে চেয়েছিল আমাদের মাঝে হয়তো এভাবেই সে ভাল থাকতে চেয়েছে ভালবাসা যে স্বার্থ দেখে না প্রিয়া! সে তো শুধু ভালবাসতেই জানে'


 | ALEEK PATA- Your Expressive World | Online Magazine |

| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |

| Bengali New Year 2024 | April-24 | Seventh Year First Issue |

| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |

| Published By : Aleek Publishers- www.aleekpublishers.com | 

| a DISHA-The Dreamer Initiative |

গল্প - সুরের টানে - দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য্য

 গল্প

 

সুরের টানে

 দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য্য

অলঙ্করণ ঃ স্বরূপ চক্রবর্তী


 

রাত আড়াইটে বেজে গেছে, হাইওয়েতে উঠে হু হু করে ছুটে চলছে স্যান্ট্রোটা, পেছনের সীটে পাশে বসে দীপ্যমান ঢুলছে, প্রবীরের চোখও ঘুমে জড়িয়ে আসছে, ড্রাইভার নারায়ণের পাশে কেউ নেই বাকীরা আরেকটা গাড়িতে, সেই গাড়িটা আগে আছে

অমাবস্যা কিনা কে জানে সামনের গাঢ় অন্ধকার গাড়ির আলোয় চিরে ছুটে চলেছে স্যান্ট্রোটা আগের বিশাল বিশাল মালবাহী লরিগুলোর লাল আলো তাদের গাড়ীর আলোয় জ্বল জ্বল করে উঠছে দানবের চোখের মত দুপাশে সম্ভবত ইউক্যালিপটাসের জঙ্গলে গাছগুলো হাত তুলে প্রেতের মত দাঁড়িয়ে আছে গাড়ীর আলো দূরের গাছগুলোয় পড়ামাত্র তারা তীব্রগতিতে গাড়ীর দিকে প্রবল আক্রোশে ছুটে এসে তারপর গাড়ীকে পেরিয়ে আরো পেছনে চলে যাচ্ছে আলো বোধহয় তাদের চোখে সহ্য হয় না মাঝে মাঝে বিকট হর্ণ বাজিয়ে কোন গাড়ি উল্কাগতিতে তাদের ওভারটেক করে চলে যাচ্ছে রাতে এভাবে হাইওয়ে দিয়ে যেতে একদম ইচ্ছে হয় না কিন্তু উপায় নেই সে যে প্রবীরকুমার! তার নামে ফাংশনে ভীড় হয় রাত এগারোটার আগে সে স্টেজে ওঠে না

 

গুরু ফাটিয়ে দিয়েছ”, “জীও পাগলা”, সিটি, হাততালি, পাবলিকের উত্তাল নাচ এমনকী নোটের মালা গলায় পরানো এসবই আজও ঘটেছে, অন্য রাতগুলোর মতই অন্য রাতগুলোর মতই সেই গোটা পনেরো গান যন্ত্র! যন্ত্র! একদম যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে সেই একই গান একই ভঙ্গিমা রাতের পর রাত পাল্টায় শুধু জায়গা আজ ভবানীপুর তো কাল মেদিনীপুর তো পরশু দুর্গাপুর

কিংবদন্তী গায়কের নকল গায়ক সে লোকে বলে অমুক কন্ঠী খুব নাম ডাক তার কিন্তু সে তো তা হতে চায়নি সে শুধু গাইতেই চেয়েছিল নানারকম গান, নানারকম সুরে সুরের তীব্র আকর্ষণেই তো সে ছুটে বেড়িয়েছে সুর সুর সুর আহা কী মায়া, কী টান সুরের, সে তো চেয়েছিল সুরের স্রোতে ভাসতে সুরের রঙে রাঙিয়ে নিতে নিজেকে সে যে সমস্ত গান গায় তাতেও সুর বড় কম নয়, কিন্তু সে তো আটকে গেছে ওই পনেরো কুড়িটা গানের সুরে অথচ কত সুর কত রঙিন ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে গ্রামে আগে শহরতলীতে প্রোগ্রাম থাকলে সে সকালেই এসে উপস্থিত হত যদি সেখানকার কিছু গান সুর সে শিখে নিতে পারে, কিন্তু তাকে দেখতেই লোকে ভীড় করে তার গানই শুনতে চায় সবাই, তাকে কেউ গান শোনায় না স্টেজে কতবার চেষ্টা করেছে তার বড় প্রিয় গানগুলো শোনাতে, কেউ শুনতে চায়নি তার ম্যানেজার ও সবসময়ের সঙ্গী দীপ্যমানও ওই গানগুলো গাইতে বারণ করেছে বড় ক্লান্ত, নিঃস্ব লাগে আজকাল

 

একটা আলোর বলয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে পুটু, চোখ ধাঁধানো আলোর মধ্যে দিয়ে তীব্র গতিতে সে চলে যাচ্ছে আরো ভেতরে, আলোর বলয়টা এখন এক গভীর অতল গহ্বর, নিজের পতন আটকাতে দুহাত বাড়িয়ে কিছু ধরার চেষ্টা বিফলে যায়, কারণ আলো ছাড়া কিছুই নেই সেখানে পেটা ঘড়ির ঢং শব্দের পর যে অনুরণনটা ছড়িয়ে পড়ে সেই অনুরণনটা ছড়িয়ে পড়ছে তার কানের মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কের কোষে কোষে, আর সেটা বেড়েই চলেছে দুহাতে কান চাপা দিতে চায় সে, ততক্ষণে আলোর রঙ পরিবর্তন হয়েছে এখন আলোর রঙ হালকা গোলাপী রঙের সাথে সাথে শব্দেরও পরিবর্তন হয়েছে এখন পেটা ঘড়ির আওয়াজের অনুরণন নয়, মন্দিরের ঝোলান ঘন্টার ঘন্টাধ্বনি, একটানা একশ ঘন্টার আওয়াজ তার মাথার ভেতরে তুফান তুলেছে আবার রঙ পরিবর্তন, এবার আলো মৃদু, শেষ বিকেলের মরা রোদের মত, পরিবর্তন শব্দেরও, এবার কেমন মৃদু চেনা মনখারাপ করে দেওয়া গানের সু্‌র, কিন্তু গানটা চিনতে পারে না সুরটা লক্ষ্য করে ছুটতে থাকে ধান ক্ষেতের আলের ওপর দিয়ে আরে কখন আলোর গহ্বরটা পেরিয়ে চলে এসেছে ধানের ক্ষেতে! এই তো একতারার আওয়াজ আর সেই গানের সুর! ওই তো দূরে বাউল ফণীকাকা গাইতে গাইতে চলেছে,

প্রাণপাখী উড়ে যাবে পিঞ্জর ছেড়ে

ধরাধামে সবই রবে তুমি যাবে চলে” 

ছুটতে ছুটতে ধরে ফেলে ফণীকাকাকে, ডাকে না, পেছন পেছন চলতে থাকে গানের কথাগুলো মগজে গেঁথে নিতে থাকে, সুর রঙে ভরিয়ে তাকে ভাসিয়ে নিতে চায়  ফনীকাকা কোথায় থাকে সে জানে না অনেকদিন বাদে বাদে আসে সামনে এখন আর ফণীকাকা নেই আছে সুর, কী টান সে সুরের, তারই পেছন পেছন চলতে থাকে পুটু সুরপাখী নানা রঙের পালকওয়ালা ডানা মেলে দেয়, সাথে সাথে পুটুও দৌড়তে থাকে কিন্তু সুরপাখী মিলিয়ে গেল পুটু ধরতে পারল না কানে আসে আবার সুর, পাখীটা কি ফিরল? ওমা! কোথায় পাখী? পুটু এখন ধানক্ষেতের মাঝে নেই, সে দাঁড়িয়ে আছে একটা চড়াপড়া নদীর ধারে বাঁয়ে বালি, ডাইনে বালি, মাঝেও বালি, সেই বালির মধ্যে দিয়ে বহুকষ্টে এঁকেবেঁকে এদিক ওদিক করে রাস্তা বের করে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে নদীটা

মাঝি বাইয়া যাও রে

অকূল দরিয়ার মাঝে আমার ভাঙ্গা নাও রে...”

নদীর জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আপনমনে গেয়ে চলেছে মইদুলদাদা কোনকালে নাকি তার দাদাজান নৌকা বাইত এই নদীতে আজ গোড়ালি ডোবা জলে দাঁড়িয়ে ভাটিয়ালি গাইছে মইদুলদাদা পাড়ের নলবন পেরিয়ে বালির চড়ায় নেমে মইদুলদাদার পাশে দাঁড়িয়ে হাঁ করে গান শোনে কিংবা গিলতে থাকে পুটু সন্ধ্যে নেমে এসেছে, কালো চাদরটা দিয়ে এখনো চারধারটা মুড়ে ফেলেনি গানের সাথে সাথে যেন আশপাশটায় নানা রঙ খেলা করে উঠছে তার চোখের সামনে বাতাসে যেন মৃদু ঢেউ খেলছে সরু সরু রঙের বৃত্ত তৈরি হচ্ছে, ভাঙ্গছে, আবার তৈরি হচ্ছে

পুটুর দিকে চোখ পড়তে গান থামায় মইদুলদাদা প্রথমটায় যেন চিনতে পারে না, তারপর বলে, “এই সন্ধ্যের মুখে এখানে কী করছিস? যা ঘর যা সাপে কাটলে আর দেখতে হবে না” তা সাপ আছেও বটে বিস্তর এ তল্লাটে

গান শুনছিলাম গো কী ভাল গাও তুমি!”

তুই গান গাইতে পারিস? শোনা একটা, না শোনালে মামাকে বলে দেব একা একা নদীর চড়ে এসেছিস” পুটুর হাত ধরে নদীর পাড়ে উঠে গাঁয়ের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে মইদুলদাদা দিনের আলো ফুরিয়েছে, তখন বেশ বড়সড় চাঁদ আকাশে, পৃথিবীটা রূপোলী আলোর চাদরে ঢাকা, দূরের গাছপালা, ঘর চালা, রূপোলী চাদরে মায়াবী কালো নকশা

মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রে

কান্দে হাসন রাজার মন ময়না রে

মায়ে বাপে কইর‍্যা বন্দী খুশীর মাজারে

লালে ধোলায় হইলাম বন্দী পিঞ্জিরার ভিতরে রে”

পুটু লজ্জা ঝেড়ে ফেলে গান ধরে, মইদুলদাদাকেই সে এই গান গাইতে শুনেছিল কব্জিতে মইদুলদাদার মুঠি ক্রমশই শক্ত হচ্ছে দেখে মইদুলদাদার দিকে তাকিয়ে পুটু অবাক হয়ে দেখে মইদুলদাদার চোখ দিয়ে জল পড়ছে, চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে মইদুলদাদার গাল বেয়ে গড়িয়ে আসা জলের দাগ তার নিজের চোখেও জল চলে আসে

বড় ভালো গাইছিস, যা সাবধানে বাড়ি যা” বলে ঝাঁকড়া বটগাছটার কাছে এসে মইদুলদাদা বাঁদিকে গেল আর পুটু ডান দিকে

ছটফট ছটফট করে মজবুত পিঞ্জরা

ময়না ভাঙ্গিতে না পারে রে

কান্দে হাসন রাজার মন ময়না রে

হায় রে কান্দে...”

হারামজাদা মা বাপকে খেয়ে হয় নি, এবার আমাকে খাবি?” মামীর হুঙ্কার আর কানে প্রবল টান পড়ায়, তীব্র ব্যথায় পুটুর গান থেমে গেল পিঠে গোটা কতক কিলও এসে পড়ে কানের গোড়ার মত চুলের গোড়া শক্ত না হওয়ায় কয়েক গোছা চুল মাথা ছেড়ে মামীর হাতে উঠে গেল 

চাঁদের আলো যেন অনেকটা ফিকে হয়ে গেল, মেঘে বুঝি বা ঢাকা পড়ল অতবড় চাঁদখানা

মাথায় টনটনানি, পিঠে কানে কনকনানি নিয়ে সে ঘরে ঢোকে

এত লোকের মরণ হয় তোর মরণ হয়না রে! সাপেও কাটে না তোকে! বাপকে খেয়েছিস, মা কে খেয়েছিস, সকলকে না খেয়ে ছাড়বি না” মামীর কথা পুটুর কানে গরম সিসে ঢেলে দেয়

সম্ভবত তার মরণ না হওয়ার লজ্জাতেই অধোবদনে থাকে চোখের জলে জামার বুকের কাছটা ভিজে যায়

ঘরে এসে আরো চড়, কিল,‌ লাঠিপেটা চলার পর বাসন মাজা, উনান ধরানো ইত্যাদি কাজও সে করে ফেলে চোখের বহতা ধারা আর জ্বলুনিটার একমাত্র কারণ অবশ্যই উনানের ধোঁয়া নয় রাতে খাওয়া বন্ধ হওয়াটা স্বাভাবিকই ছিল ছোট ছোট মামাতো ভাই বোন দুটো তাকে ভালবাসে, তারা মায়ের চোখ এড়িয়ে ক’টা নারকেল নাড়ু দিয়ে গেছে মামী জানতে পারলে ওদের কপালেও দুঃখ আছে মামার দোকান সাঁইথিয়ায়, সপ্তাহে একদিন বা দুদিন আসে মামাও তাকে পছন্দ করে না, নেহাৎ লোকলজ্জার ভয়ে তুমুল অনিচ্ছায় তাকে পুষছে তবে মামীর মত অত্যাচার করে না বারো বছরের পুটু, ক্লাস ফোর অবধি পড়ার পর স্কুল যাওয়া ঘুচেছে সে স্কুলে গেলে কে করবে বাড়ির কাজ চাষের সময় ক্ষেতে খাটাই বা কে খাটবে! অবশ্য চাষ এখানে বছরে একবারই হয় বর্ষায়

একপেট ক্ষিধে আর এক গা ব্যথা নিয়ে শুয়ে ভাঙ্গা টালির ফাঁক চুঁইয়ে আসা চাঁদের আলো গায়ে মেখে এপাশ ওপাশ করে রাত কাটায় পুটু জোছনাও কি তার গান শুনতে চায়? শোনে কি? হাজার ব্যথা যন্ত্রণাতেও পুটুর আধোঘুমে বা আধোজাগরণে, চেতনে বা অবচেতনে সুরের বর্ণচ্ছটা খেলা করে যায় আর তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে

 

পরের তিনদিন সে বাড়ির বার শুধু এই কারণে হয়নি যে, বাড়ির বাইরে গেলে মামী ঠ্যাং খোঁড়া করার হুমকি দিয়ে রেখেছে, গায়ের ব্যথা গালে চড়ের দাগ আর কপালের কালশিটেও তার বাড়ির বাইরে না বের হওয়ার অন্যতম কারণ 

 

আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা

মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা 

তার উপরে সদর কোঠা

আয়না মহল তায়”

শেষ বিকেলে দূর থেকে ফনীকাকার গানের কলি শুনেই ছুট ছুট ছুট ফনীকাকা চলেছে ক্ষেতের সীমা পেরিয়ে সরু পায়ে চলার পথ ধরে স্টেশন পানে ফনীকাকার চলার গতিবেগ ভালই তার গতির সাথে তাল রেখেই পেছন পেছন চলেছে পুটু, সুর সুর আর সুর! সুরের মায়াজাল টেনে নিয়ে যাচ্ছে পুটুকে

মন তুই রইলি খাঁচার আশে,

খাচা যে তোর কাঁচা বাঁশের

কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে”

গানে মাতোয়ারা পুটু ফনীকাকার পেছন পেছন ছোট ছোট দোকানগুলোকে ডাইনে ফেলে, বাঁয়ে শিবমন্দির ছাড়িয়ে, পুকুর পাড় ধরে স্টেশনে পৌঁছে যায় ট্রেন এলে, ট্রেনে উঠেও পড়ে, স্টেশনে ছেড়ে যাওয়ার সময় তার ক্লাস ফোর অবধি পড়া বিদ্যে কাজে লাগিয়ে স্টেশনের নামটা পড়েও ফেলে ‘পান্ডবেশ্বর’

ট্রেনে সারাক্ষণ ভীড়ের মাঝে লুকিয়ে ফনীকাকার গান শুনতে শুনতে সময় কেটে যায় ফনীকাকাকে অনেকে গান শুনে খুশী হয়ে টাকা পয়সা দিচ্ছিল এ অবধি সব ঠিকঠাক চলছিল, ফনীকাকার কাছে ধরা খেল বর্ধমান স্টেশনে নেমে পুটুর কান্না আর জেদের কাছে হার মানতে হল ফনীকাকাকে

ফনীকাকা আশ্রয় দিল পুটুকে কিন্তু তার মনে পুলিশি ঝামেলার ভয়ও ছিল ফনীকাকা গিয়েছিল পুটুর মামার কাছে আপদ বিদায়ের খুশীতে মামা মামী ফনীকাকাকে বলে দিয়েছিল পুটুকে ফেরত আনার দরকার নেই

একলা মানুষ ফনীকাকার কাছেই থাকতে থাকতে সুর তাল লয় শিখতে লাগল নানারকম কষ্ট থাকলেও গানের সাথে সুরের সাথে থাকার আনন্দে মশগুল ছিল পুটু

বর্ধমানেই নানারকম গান নানারকম সুরের সাথে পরিচয় হতে লাগল পুটুর মোড়ের পানের দোকানের হিন্দী গান, পূজোপার্বনে মাইকে হিন্দী বা বাংলা গান আর সঙ্গে ফনীকাকার বাউল গান ছিলই কোনটা বাউল গান, কোনটা আধুনিক জেনেছিল ফনীকাকার কাছে ফনীকাকা অবশ্য বাউল গান ছাড়া কিছু গাইত না ফনীকাকার কাছে গান শেখা তার কাছে অমূল্য অভিজ্ঞতা ফনীকাকা কক্ষণো তাকে মাধুকরীতে সঙ্গে নিত না, যতদিন না ফনীকাকার শরীরে কাশির সাথে রক্ত বের হওয়ার অসুখটা বাসা বাঁধল ফনীকাকা মাধুকরীতে বের হলে সে রাস্তায় রাস্তায় গান শুনে বেড়াত অসুখটা হওয়ার পর আর ফনীকাকা সেভাবে গাইতে পারত না তখন সাথে নিত পুটুকে সেই পুটুর পুরো দস্তুর গান গাওয়া শুরু

তারপর একদিন ঝড় বৃষ্টির রাতে ফনীকাকা শেষবারের মত একদম ঠিকঠাকভাবে একটুও না কেশে গুনগুনিয়ে গাইল,

খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার

খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার কোনখানে পালায়

কেমনে আসে যায়,

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়”

 

একদম একা হয়ে গেল পুটু ততদিনে সে বয়সটা আরো বছর ছয়েক বাড়িয়ে নিয়েছে

ততদিনে সুরের টানে পুটু পাগল ট্রেনে নানাধরনের গান গাওয়া চলছে আর নতুন সুর নতুন গান শুনলেই সেই সুরের আকর্ষণে পাগল হয়ে ছুটছে সেই সুর গলায় না তুলে শান্তি নেই

কী যে ভাল লাগত, বর্ধমানের গানের স্কুলের একমাথা পাকাচুল ফর্সা দিদিমণি যখন গাইতেন, ছাত্রদের শেখাতেন সে চুপ করে বাড়ির বাইরে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে শুনত,

তোমার অভিসারে

যাব অগম পারে,

চলিতে পথে পথে

বাজুক ব্যথা পায়ে”

কখন যে চোখ দুটো নিজের অজান্তেই ভিজে যেত 

 

ট্রেনে গান গাইতে গাইতে একটা ধাক্কায় ছিটকে যায় পুটু, রঙ রঙ নানা রকম রঙ সুর আর সুর আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে রঙ বেরঙের সুর ঝর্ণার মত, নানা রঙের আলোর মধ্যে দিয়ে সে একটা হাউইয়ের মত উঠে যাচ্ছে আকাশে এ আকাশ তো সে চেনা আকাশ নয়, একটার পর একটা রঙ, একটার পর একটা সুর পার হয়ে উঠে যাচ্ছে কে? না পুটু তো নয় এ তো প্রবীরকুমার 

 

এখন এ কোথায় এল সে! এ তো আকাশ নয় সন্ধ্যের আলো ছায়া অন্ধকার ঘেরা শহর রাস্তার আলো জ্বলছে, সামনে গঙ্গা কলকাতার গঙ্গার ধার রাস্তার আলো, গঙ্গা পাড়ের আলো, ঢেউয়ের মাথায় পড়ে চিকচিক করছে গঙ্গায় নৌকা চলছে ঢিমে গতিতে গঙ্গার ধারে আলো আঁধারিতে বসে যুবক প্রবীরকুমার, পাশে ভারি মিষ্টি মায়াকাড়া চেহারার  যুবতীটি যেন চেনা চেনা ঠেকছে হ্যাঁ, চেনাই তো! ও তো তৃণা প্রবীরকুমারের জীবনসঙ্গিনী হতে পারত কিন্তু শেষ অবধি হয়নি একচিলতে আলো রাস্তার দিক থেকে কী করে যেন পিছলে এসে তৃণার বাঁদিকের গালে তেরছা হয়ে পড়েছে বড় মোহময়ী লাগছে তাকে মৃদু স্বরে প্রবীরকুমার গাইছে,

পরাণে বাজে বাঁশি

নয়নে বহে ধারা

দুখের মাধুরীতে

করিল দিশাহারা”

সত্যি সত্যি গান শুনে তৃণার চোখ দিয়ে  ধারা তার গাল বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে সুরের আকর্ষণে ছুটেও নাগাল পেল না, তৃণার আকর্ষণে পাগল হয়েও তাকে পাওয়া হল না আফশোষ তো আছেই এ জীবনে হল না যদি একবারের জন্যেও অন্তত ঠিকঠাক সুরগুলো ছুঁয়ে যেতে পারত! ফনীকাকা ফেলে গেল, তৃণা অধরা রইল, সুরও রইল নাগালের বাইরে

 

চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোটা ক্রমেই নিভে গেছে অনেকক্ষণ, আকাশের তারাগুলো টিমটিম করতে করতে একটা একটা করে নিভে যাচ্ছে সেই মহাশূন্য যা এতক্ষণ হাজার রঙে রঙিন ছিল, যা বহু সুরে মুখর ছিল সে এখন ক্রমেই রঙ হারিয়ে কালচে, সুর হারিয়ে নিস্তব্ধ সেই মহাশূন্যে প্রবীরের অগ্রগতি এখন গতিহীন, দিশাহীন, এলোমেলো বিচরণ অন্ধকারে পথের সন্ধানও পায় না, স্তব্ধ মহাশূন্যে সুর অনুসরণ করে এগোবারও উপায় নেই নিভন্ত তারাদের দলের শেষ তারাটার আলো নিভে যাওয়ামাত্রই, সেই নিস্তব্ধ নিকষ কালো অতল অন্ধকার গ্রাস করে নিতে থাকে প্রবীরকে দ্রুত, অতি দ্রুত, কালো, আরো কালো, গহীন গভীর অতল অন্ধকারে হু হু করে তলিয়ে যেতে থাকে সে

 

ড্রাইভার নারায়ণ আর চেষ্টা করেও চোখ খুলে রাখতে পারছিল না, কেউ যেন জোর করে তার চোখ দুটোকে বন্ধ করে ঘুমের দেশে তাকে ডুবিয়ে দিল তার পা অ্যাক্সিলারেটরে আরো জোরে চেপে বসল

 

উল্কার গতিতে স্যান্ট্রোটা যখন সামনের দৈত্যাকার ট্রেলারটার পেছনে আছড়ে পড়ে তিনজন ঘুমন্ত আরোহীকে নিয়ে দলা পাকিয়ে ট্রেলারটার নীচে ঢুকে যাচ্ছে তখন মহাশূন্যের অতল অন্ধকারে হু হু করে তলিয়ে যেতে থাকা প্রবীর শেষবারের মত হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইল তার প্রিয় সুরটাকে,

 

সকলই নিবে কেড়ে

দিবে না তবু ছেড়ে,

মন সরে না যেতে

ফেলিলে একি দায়ে...”

 

সেই মুহূর্তের প্রবীরের ঠোঁটের কোণের শান্ত হাসির রেখা আর চোখ থেকে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের রেখা কারো দেখা হল না

 | ALEEK PATA- Your Expressive World | Online Magazine |

| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |

| Bengali New Year 2024 | April-24 | Seventh Year First Issue |

| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |

| Published By : Aleek Publishers- www.aleekpublishers.com | 

| a DISHA-The Dreamer Initiative |


Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান