অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Showing posts with label SUMMER-MONSOON 2020. Show all posts
Showing posts with label SUMMER-MONSOON 2020. Show all posts

Friday, August 28, 2020

রহস্য- রোমাঞ্চ-বৃষ্টিস্নাত এক রাতে- শম্পা সান্যাল


বৃষ্টিস্নাত এক রাতে

শম্পা সান্যাল

Image Courtesy: Google Image Gallery


আমার এই লেখা দিনে, বা রাতে জোরালো আলোর নীচে পড়ার জন্য নয়। উপভোগ করতে চাইলে পড়ুন, একটু নরম আলোর নীচে। একটু নির্জন। ঘন বর্ষার রাত, লোডশেডিং। পরিবেশের একটা প্রভাব তো থাকেই, তাই না! না , না, মজা করলাম। তবে এই অভিজ্ঞতা যা বলতে বসেছি ; সেইসময় যে আবহে এই ঘটনা, সেই আবহ যদি আমার সাধ্যমত প্রকাশ করতে পারি, ধারণা করে নিতে পারেন , বলবো, একটু শিউরে উঠবেন, উঠবেন‌ই।
সময়টা সত্তরের দশক। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পর সেজো মামার সাথে আমি আর ছোটমাসী 
( সমবয়স্কা, বান্ধবী বলাই সঙ্গত) দার্জিলিং বেড়াতে গেছিলাম। তখন সোজাসুজি দার্জিলিং পৌঁছানো যেতো না। মাঝে লঞ্চে করে পারাপার। তখন দার্জিলিঙের যে সৌন্দর্য্য সে কেবল সেসময় যারা গেছেন তাদের মনে আঁকা হয়ে আছে। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত পরিবেশে, গরম- প্রধান অঞ্চলের আবাসিক আমরা ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। উপভোগ্য সেটাও। হ্যাঁ, সেসময়ের তুলনায় আজ ঠান্ডাও কমে গেছে আমাদের কার্যকারিতার গুণে। যাইহোক, চারদিন ঘোরা, বেড়ানো খাওয়া দাওয়ায় অমলিন স্মৃতি নিয়ে এবার ফিরে চলার পালা। মনে মনে বললাম "আবার আসবো। ভালো থেকো তুমি"
 মনিহারি ঘাট থেকে স্টিমারে কি ভালো লাগছে! কিন্তু সমস্যা শুরু হলো সকরিগলি ঘাটে এসে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, নেমে মালপত্র নিয়ে কাদা বালির ওপর দিয়ে তাড়াতাড়ি যাওয়াও যাচ্ছে না। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে, তবে ইঞ্জিন লাগেনি। আর সেকারণে কামরা গুলো অন্ধকার। মামা যা বোঝার বুঝে আমাদের নিয়ে উঠলেন এক কামরায়। মামা লাইটার জ্বালিয়ে আমাদের বললেন, উপরের বার্থে দুজনে চলে যা। আমাদের পিছন পিছন এক ভদ্রলোক তার স্ত্রী আর শিশু সন্তানকে নিয়ে উঠেছেন। তারা আর মামা নীচে বসে। বাইরে হালকা কোলাহল, স্টিমার থেকে নেমে সব আসছেন। অল্পস্বল্প ভিজেছি, ঠান্ডা লাগছে। ব্যাগ থেকে জামা কাপড় বের করে যে চেঞ্জ করে আসবো, অন্ধকারে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। তার উপরে এখনকার মতো তো চেন টানা নয়, তালার ঘাট লাগানো স্যুটকেস।  জানলা দিয়ে হালকা আলো এসে পড়েছে। বাইরের কোলাহলও স্তিমিত। জোরে বৃষ্টি নেমেছে ;  প্রায়ান্ধকার কামরায়  আমরা সবাই ঠিক স্বস্তি বোধ করছি না।  বাচ্চাটাও ঘুমিয়ে পড়েছে। হালকা কথাবার্তা চলছে। আচমকা চমকে উঠলাম আমরা সবাই।  বৃষ্টির সুরেলা আওয়াজ ভেদ করে কানে এলো ভারি বুটের আওয়াজ, ঠক্। ঠক্। ঠক্। ক্রমশঃ শব্দ জোরালো হচ্ছে, অর্থাৎ আমাদের দিকেই আসছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকের ভিতর যেন দুমদুম করে হাতুড়ি পিটাচ্ছে কেউ। লোয়ার বার্থে ভদ্রমহিলা বাচ্চাটাকে জড়িয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছেন।  ভদ্রলোক উদ্বিগ্ন স্বরে মামাকে কিছু বলতে যেতেই মামা  মুখে আঙ্গুল দিয়ে বললেন-"চুউউউপ্"। যেভাবে মামা গলা নামিয়ে " চুউউপ্"  শব্দটা ছড়িয়ে দিলেন, শব্দটা এসে নাড়িয়ে দিলো সবাইকে। আতঙ্ক শব্দটা জানা ছিল, জানা ছিল না তার ভয়াবহ আক্ষরিক অর্থ। নিমেষে আতঙ্ক গ্ৰাস করেছে আমাদের সবাইকে। অন্ধকারে কেবল মাত্র আলো মামার সিগারেটের মুখে। শব্দটা আচমকা যেমন এসেছিল, একদম কাছে এসে তেমনি আচমকা থেমেও গেল! মন উসখুস করছে, নড়ার শক্তি হারিয়েছি। শক্ত হয়ে তাকিয়ে আছি শব্দ- উৎস-পানে। অদ্ভুত এক নিরবতায় দমবদ্ধ পরিবেশ। পাশের কামরার কোনো যাত্রী তো হতে পারেন! কিন্তু তৃতীয় নয়ন অবলোকন করছে অন্য কিছু,  আর তাই সে মেসেজ পাঠাচ্ছে, সাবধান! সময়ের হিসেব গেছে গুলিয়ে। ক্রমশঃ প্রকাশিত,  কালো টুপিতে (আলো আঁধারে যেটুকু বোঝা গেল) মুখটা একটু আড়ালে, লং কোট পরা এক দীর্ঘদেহী এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে। রুদ্ধশ্বাসে এক নিমেষে যতো অপ্রীতিকর ঘটনার কথা ঘাই মারছে মাথায়। আস্তে আস্তে শব্দ এগিয়ে গেল আমাদের কামরা ছাড়িয়ে। ওঃ, সহযাত্রী!  অন্ধকারে নিজের  ক্যুপ খুঁজছেন। খামোখা আমরা সবাই ভয়ে মরলাম। উফফ্, হালকা লাগছে। শব্দটাও থেমে গেছে। ভদ্রলোক মামাকে আবারো উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে যেতেই মুখে আঙ্গুল দিয়ে মামা আবারও থামিয়ে দিলেন।  যদিও থামানোর কোনো দরকারই ছিল না। আপনি সবাই থমকে যেতো, গেলোও! একটা নারী কন্ঠের আর্ত চিৎকার আমাদের ভিতর-সহ নাড়িয়ে দিয়ে গেলো। গলা শুকিয়ে আসছে। বুকে আবারো দ্রুতলয়ে হৃদস্পন্দনের শব্দ যেন কানে তালা ধরিয়ে দেবে। মনে তো হলো,একদম পাশেই। মানে, পাশের ক্যুপে? নাকি! তার পরেরটায়!  উনি কি একা! আমরা উঠে যাবো? বলবো মামাকে? কোনরকমে যেন অবশ শরীরকে চালনা করে মাথা ঘুরিয়ে মামার দিকে তাকালাম।  চেন- স্মোকার নন্। দেখলাম, বিচলিত মামা একটা থেকে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে নিলেন। উত্তেজনায় আমাদের প্রত্যেকের তখন যে কি করুণ পরিস্থিতি!  যখন পাশের কুপের পরিস্থিতি ভাবনায়, আমাদেরই  একজনের আচমকা গোঙিয়ে ওঠার ছোট্ট আওয়াজ; নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে আবার  দীর্ঘাকৃত অবয়ব। হঠাৎ বিদ্যুৎ- এর ঝলকানিতে আলোকিত মুহূর্তে সবাই দেখলাম-পুরুষ নয়; এক নারী অবয়ব। কি ভয়ঙ্কর! ভয়ে চোখ বন্ধ করতেও কি ভুলে গেছিলাম, নাকি! করেছিলাম! উপরে শান্ত থেকে মামা এবং ভদ্রলোকটি পাথরের মূর্তির মতো বসে। অন্ধকারে সিগারেটের আগুনের রঙটাও যেন একদম উপযুক্ত, এই আবহে। ঘন অন্ধকারে একটা ছোট লালচে-কমলা স্ফুলিঙ্গ জ্বলছে- নিবছে। যেন কোনো সংকেত- ধ্বনি , না এখন সেকথা মনে হচ্ছে। তখন ঐ আলোটুকুও ভালো লাগছিল না, সত্যি। ভিতরের অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় বিস্ফারিত চোখ বুজে গেল একটা ধাক্কায়, আপনি মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো-মাগো!  কতোটা সময় কেটেছে জানিনা, আজো মনে হয় অন্তহীন একটা সময় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের মনে।  জোরালো আলোয় চোখ মেললাম। (অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকার দরুন ট্রেনের মিটমিটে আলোও তখন জোরালো)। ইঞ্জিন লেগেছে, তাই মৃদু দুলুনি হয়েছে। ভয়ের আঙ্গিকে তাই ধাক্কা বলে ভেবেছি। নেই। দীর্ঘদেহী অদৃশ্য। হৈহৈ করে একদল ছেলে এসে উঠলো আমাদের কামরায়। দমবদ্ধ পরিবেশ ভেঙ্গে  আমরা সহজ ভাবে শ্বাস নিলাম ;  এতোক্ষণ! কতোক্ষণমনে নেই। না,  রুদ্ধশ্বাস নাটকের যবনিকা পতনের শুরু- শেষ  সময় মাপতে দেয়নি।  খুব ক্লান্ত লাগছে, সবার‌ই মুখে স্বস্তির ছাপ কিন্তু , তারপর ঐ ছেলেগুলো আমাদের কথা শুনে যা বললো তাতে আমরা আবার নতুন করে ভয়ের বাতাবরণে। 
বিশ্বাসের জায়গা প্রত্যেকের নিজস্ব।
ওরা শুনে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে দিলো, যা থেকে আমাদের প্রত্যেকেরই  মনে হলো কিছু একটা ব্যাপার আছে। তারপরই ওরা নেমে যেতে উদ্যত। মামা এবং ঐ ভদ্রলোক উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন ,কেন‌ ওরা মালপত্র তুলে নিচ্ছে! ওদের বক্তব্য-আজকের তারিখে,এই রাতে প্রত্যেক বছর এই ঘটনা ঘটে এই  ট্রেনে। এখন বুঝতে পারছে, এতো ফাঁকা কেন ট্রেন! আজকেও  ঘটেছে কাজেই ওরা এখানে থাকবে না।
-"তাহলে উঠলে কেন?"
-তারিখটা মনে ছিল না আর সামনে ফাঁকা কামরা পেয়ে উঠে পড়েছিল।
মামা বললেন,"অন্য কামরায় গেলে কি লাভ! ওখানেও তো দেখা দিতে পারে!"
অল্পবয়সী ছেলেরা শুনে একটু ঘাবড়েও গেল।
ভদ্রলোক তো ওদের পায়ে পড়তে পারলে বাঁঁচেন এমন অবস্থা আমাদের সাথে তোমরা থাকো প্লীজ। দেখলে না আলো এবং তোমরা আসাতে চলে গেছে। আর আসবে না।
মামাও বললেন,"একসাথেই থাকি বরং। আর আলো কেউ নেভাবে না, কেমন!"
ওরাও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলো, থাকবে।
এখন যেমন পা ফেলার জায়গা পাওয়া যায় না, তখন সেরকম ছিল না। ভয়ে ভয়ে আমি আর মাসী ওয়াশরুমে গেলাম, আসলাম। প্রতিটি ক্যুপ লক্ষ্য করলাম, ইতিমধ্যে ঐসব ক্যুপেও কয়েকজন যাত্রী এসে গেছেন। দুই-একটা ক্যুপ ফাঁকা। না, কোনো অপ্রীতিকর দৃশ্য চোখে পড়লো না অথচ আওয়াজ তো এদিক থেকেই এসেছিল। আমাদের আগে মামারাও ঘুরে দেখে গেছেন।  ঐসব যাত্রীদের আমি আর মাসী সদ্য ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ওদের কাছে ব্যক্ত করতে চাইলেও মামা মাথা নেড়ে নিষেধ করলেন। পুরো ক্যুপটা করে দেখে দরজা দেওয়া হলো। ছদ্মবেশী মানুষের কুকীর্তি করার প্রচেষ্টা হওয়াটাই বাস্তব, পরা-বাস্তব মেনে নিতে সময়তো লাগেই, একটুও যদি যুক্তিবোধ থাকে, তাই না! ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। শুয়ে পড়েছি প্রায় সবাই, যদিও, ঘুম আসছে না। ফিরে ফিরে আসছে কিছুক্ষণ আগের মুহূর্ত। ভাবতে না চাইলেও ভুলতে পারছি না। সবাই ভয়ে আলো জ্বালিয়ে শুয়েছে। আমাদের ক্যুপের ডানদিকের প্রথম ক্যুপটায় আলো জ্বলছে না কোনো কারণে। ঐ ক্যুপে কেউ নেই যদিও কিন্তু ঐ ক্যুপ হয়ে ওয়াশ রুমে যেতে হবে। যেদিক থেকে আওয়াজ পেয়েছিলাম অর্থাৎ আমাদের বাঁদিকে কৌতুহল এবং প্রয়োজনে ঐদিকের ওয়াশরুমে তাই  গেছিলাম। অবশ্যই মামাকে সঙ্গে নিয়ে।  তখনতো ওদিকেও লোকজন তাই ভয় লাগেনি । মামাও আর দাঁড়াননি। তবে আমি আর মাসী তখনো পুরোপুরি আতঙ্ক-মুক্ত ন‌ই তাই দরজা ভিজিয়ে একে অপরকে সাহস দিয়ে কোনোরকমে যথাস্থানে ফিরে এসেছিলাম। এসব ভাবনার মাঝে সারাদিনের এবং সন্ধ্যেবেলার তীব্র মানসিক ক্লান্তিতে একসময় চোখ লেগেও এসেছে,  ছেলেদের তীব্র কোলাহলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। সবাই উঠে পড়েছি। মামা চপ্পল গলিয়ে  ওদের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। সাথে সাথে নীচের ভদ্রলোকও।
এপাশে ওপাশে সবজায়গায় আলো জ্বলছে, কেবল প্রথম ক্যুপের ভিতরটা অন্ধকার তাই মনে ভয় আসেনি। সেকারণে একটি ছেলে ওপাশের ওয়াশরুমে যেতে গিয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেছে। কেন! ঐ আবছা অন্ধকারে ও নাকি পরিষ্কার দেখেছে সেই দীর্ঘদেহী কে। মনের ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। অবচেতন মনে ভয়ের থেকে জন্ম নেওয়া ইলিউশন।
কিন্তু থমকে গেলাম প্রত্যেকেই।  আমরা কেবল এক দীর্ঘদেহীকে দেখেছি ,এটুকু  তথ্য পেতেই ওরা এতো ভয় পেয়েছিল যে বিশদ বর্ণনা দেওয়া আর হয়নি। ঐ ছেলেটি বিশদ বর্ণনা দিতে আমাদের পারস্পরিক চোখাচুখি বুঝিয়ে দিলো, মিথ্যে বলছে না।
এখন আমি আপনাদের বিশদে বলতেই পারি। বিশ্বাস করবেন কিইই!
অপেক্ষায় রাখাটা ঠিক হবে না।  তবে আপনাদের বিশ্বাস করিয়েই ছাড়বো। শুনুন তাহলে!
বিশদেই বলছি-ছেলেটির বর্ণনা দিলো এক ভয়ঙ্কর-মুখী মহিলার। হালকা আলোতে যতোটুকু দেখতে পেয়েছে। হ্যাঁ, আমরাও তো তাই দেখেছি!  মুহূর্তে আমাদের আবারো গ্ৰাস করলো ভয়। তখন ছেলেটিকে সুস্থ করাই প্রধান কাজ। রাতও ফুরিয়ে আসছে। ছেলেটিকে সবাই মিলে নানা চেষ্টা করে স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে আনতে ভোর হয়ে গেল। রাতের আবেশময় পরিবেশ দিনমনি গ্ৰাস করে সব রহস্যের কিনারা করে দিলো। দীর্ঘদেহীর ইঞ্জিন লাগার অভিজ্ঞতা ছিল অবশ্যই আর তাই সে দ্রুত নির্গমনের চেষ্টায় ভয়ঙ্কর-মুখী পুতুলটিকে নিয়ে অগ্ৰসর হলেও সম্ভব হয়নি কম্পার্টমেন্ট থেকে সরে পড়া ; কারণ ঐ দরজা দিয়েই ছেলের দল হৈহৈ করে উঠে পড়ে।  হ্যাঁ, যাকে দেখে আমাদের প্রাণবায়ু প্রায় যায় যায় হয়েছিল তিনি একটি নিরীহ পুতুল বিশেষ! প্রথম ক্যুপ টিতে না জ্বলাতে সুবিধা হয়েছিল। পুতুলটিকে ঐ ক্যুপ রেখে সুযোগ বুঝে নেমে গেছে সেই দীর্ঘদেহী। সুযোগ আমরাই তো করে দিয়েছিলাম ছেলেগুলো ওঠা মাত্র। ওদের দেখেই তো আমাদের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি বাক্যালাপ  বিনিময় তাকে সরে যেতে সাহায্য করে ছিল। হয়তো ভেবেছিল, সুবিধা মতো আবারও উঠে খেল্ দেখাবে কিন্তু সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবদিক বন্ধ এবং আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়তো সে সুযোগ দেয়নি।  গন্ডগোলের আওয়াজে ঐদিকের মানুষ- জন‌ও এসে গেছেন। পরে ,পরে জানলাম বছরে এই একদিনই নয়, মাঝেমধ্যেই এভাবে অন্ধকারে যাত্রীদের বোধের বাইরে পাঠিয়ে লুঠ করে নেয় তাদের সর্বস্ব। সেকারণে ওরাও খুব সতর্ক ছিলেন। একার কাজ বলেও মনে হয়না এখন।  ছেলের দল কিন্তু তারিখেই অনড় থাকলো।  এটাও মানুষের সৃষ্ট তারিখ হ‌ওয়াই স্বাভাবিক। পরপর দু-চার বছর তারিখগুলো রক্ষা করতে পারলে ঐ দিনগুলোতে ট্রেন ফাঁকা থাকবেই আর সেই সুযোগ নিয়ে চলবে বে-আইনী লেন-দেন।  এবারে বলি, মামা ক্যালকাটা পুলিশের ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্টে কর্মরত ছিলেন।  মামা আলিপুরদুয়ারে নেমে ছিলেন, দেখেছিলাম। কেন , বুঝিনি। এখন সবাই জানলাম ঐসময় দ্রুত স্টেশনমাস্টারকে নিজ-পরিচয় দিয়ে অভিযোগ জানিয়ে এসেছেন। আজো মনে পড়লে ভাবি,  মামা এতো স্থির ছিলেন যে অবাকই হচ্ছিলাম। না! বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রাখার‌ও শিক্ষা নিতে হয়েছে যে!  একটু হলেও সে শিক্ষা আজো কাজে লাগাই। ভয়ঙ্কর মুখশ্রী- যুক্ত পুতুলটিকে দিনের আলোতেও যেন স্বাভাবিক লাগছে না। ভয় এমনই এক অনুভূতি! আশ্চর্য এটাই, ছেলেগুলোর চোখে আগে পড়লো না কেন! আবারো সর্বসিদ্ধান্ত মেনে নিতে হলো অর্থাৎ পুতুলটি উপরের ব্যাঙ্কে রেখে গেছিল। ট্রেনের দুলুনিতে অবশেষে সে পপাত , ঘটনাচক্রে তারসাথে ঐ ছেলেটিও। শিয়ালদহ স্টেশনে আবারো কমপ্লেইন করার পর রেল- পুলিশের হাতে পুতুলটিই ধরা পড়লো, আমরা বোকার হাসি হেসে পারস্পরিক সৌজন্য আদান প্রদান করে বাড়ির পথে।
আলো ও আঁধার। ধাঁধার মতোন আমাদের জীবনে। দুই-ই উপভোগ্য।
মাঝে মাঝে ভয় পেলে মন্দ কি!



সমাপ্ত



| Aleekpatamagazine.blogspot.com |
  |ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Monsoon Issue,2020 | July-September 2020 |রিমঝিম সংখ্যা।
| Third Year Sixth Issue |23 rd Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
 সূচি পত্র / Index





কবিতা-চেতনার মশাল - জিতেন্দ্রনাথ গিরি


চেতনার মশাল 

জিতেন্দ্রনাথ গিরি
Image Courtesy : Google Image Gallery

জীবনের মশাল জ্বালিয়ে
মৃত্যুকে জয় করেছি অনেকবার ।
ইচ্ছার সংগ্রামে জীবনের যুদ্ধ
জিতেছি অনেক ।
সংঘর্ষের মিছিলে আর রক্ত নয়,
প্রিয় বন্ধুগণ
ফুল ছড়ানোর দিন এসেছে ।
ইতিহাসের পাতায় এবার লেখা হোক
নতুন কথা, নতুন ছন্দে ।
যারা ধুলোয় মরে আর ধুলোয় বাঁচে প্রতিদিন,
তাদের চোখের পাতায় দেওয়া হোক
নতুন স্বপ্ন ।
তাদের মনের মাটিতে রোপন করা হোক
নতুন ভালোবাসার বীজ ।
আগামীর ভৈরবীতে গাওয়া হোক
তাদেরি জয়গান ।
তাদের উন্মেষে প্রফুল্লিত হোক
আগামীর ভোর, দূরন্ত আবেগে ।
যারা উঁচু তলার মানুষ
তারা বুঝতে শিখুন,
গরীব হওয়া কোন পাপ নয় ।
গরীবের রক্ত আর শ্রম দিয়েই
তৈরি হয় উঁচু তলার ছাত আর সিঁড়ি ।
গরীবের মৃত্যু দিয়েই তৈরি হয়
ধনীর রাজপ্রাসাদ আর
লেখা হয় সুখের ইতিহাস ।
চেতনার জয়োচ্ছাসে
যেদিন কেঁপে উঠবে সারা পৃথিবী ।
বাতাস হয়ে উঠবে ঝড়,
স্বপ্নেরা ঢেউ তুলে আনবে প্রলয়,
ইঁটের রাজপ্রাসাদে বঞ্চনার ভূমিকম্প জেগে
গুঁড়িয়ে মিটিয়ে দেবে সব ধুলোয় ।
সেদিন ধনীদের দুষ্কর হবে বাঁচা ।
সেই দিনগুলো বেশী দূরেও নয়,
শতাব্দীর প্রস্তর ফলকে কোন শিল্পী
খোদাই করছে সেই যুগোত্তীর্ণ লেখা,
তার ছেনী আর হাতুড়ীর আঘাতে ।
কল্পনার সোপানে দাঁড়িয়ে
বিশ্ব বিজয়ীর মতো
মাথা উঁচু করে ।



সমাপ্ত



| Aleekpatamagazine.blogspot.com |
  |ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Monsoon Issue,2020 | July-September 2020 |রিমঝিম সংখ্যা।
| Third Year Sixth Issue |23 rd Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
 সূচি পত্র / Index


কবিতা-দ্বিতীয় ঋতু- শ্রাবণী গুপ্ত সরকার


দ্বিতীয় ঋতু

শ্রাবণী গুপ্ত সরকার
Photography: Swarup Chakraborty


আকাশে ভাসে যবে আষাঢ়ের মেঘ
মনমাঝে জাগে সেই অচেনা আবেগ।
গগনের জল আসে নেমে ধরাতলে
মেঘ বালিকার দল হাসে কুতুহলে।
বেল, কেয়া, জুঁই আর কদম্বের ঘ্রাণ
আকুল করে যে কত আতপ্ত পরাণ।
বিদ্যাপতি ভণে, চন্ডীদাস গায়...
রাধার দুঃখ বুঝি মন জুড়ে ছায়।
তুমুল বরিষণ আর দেয়া গরজনে
মেঘদূত এসে যেন ধরা দেয় প্রাণে।
উর্বী ও নভের এই মিলন মুহূর্ত
ধরে রাখে যে মোর বিমুগ্ধ চিত্ত।


সমাপ্ত



| Aleekpatamagazine.blogspot.com |
  |ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Monsoon Issue,2020 | July-September 2020 |রিমঝিম সংখ্যা।
| Third Year Sixth Issue |23 rd Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
 সূচি পত্র / Index







শিশুতোষ কবিতা- আজ সকালে - সুধাংশু চক্রবর্তী



আজ সকালে

সুধাংশু চক্রবর্তী

Photography By: Swarup Chakraborty


ভোরের আকাশ বুকে নিয়ে হালকা মেঘের সারি
সেজেছে আজ ইচ্ছে মতো লাগছে ভালো ভারী ।
একটা কালো পানকৌড়ি
ডুবে ডুবে মাছ খাচ্ছে ধরি
পেটটি ভরে মাছ খেয়ে সে যাবেই ফিরে বাড়ি ।
তালগাছের পাতায় পাতায় বাবুই পাখির বাসা
বাতাস লেগে আপন মনে দুলছে কেমন খাসা ।
বুনছে বাসা বাবুইপাখী
শিল্পকলা টানছে আঁখি
জোনাক ধরে জ্বালবে আলো মনের সুপ্ত আশা ।
গুটিকতক প্রজাপতি, ওদের রঙ্গীন ডানা মেলে
উড়ছে বসছে খাচ্ছে মধু গাছের ফুলে ফুলে ।
ভোমরা এবং মৌমাছিতে
মেতেছে আজ নৃত্যগীতে
মাখছে গায়ে ফুলের রেণু ভাবনা চিন্তা ভুলে ।
টুনটুনিতে টুনটুনালো, চড়ুই করে কিচিরমিচির
দোয়েল ফিঙ্গে জুটে এসে করলো সেথায় ভিড় ।
পাখপাখালির কলতানে
ভোরের আকাশ গানে গানে
ভরেছে দেখে খোকন সোনার মন থাকে না স্থির



সমাপ্ত



| Aleekpatamagazine.blogspot.com |
  |ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Monsoon Issue,2020 | July-September 2020 |রিমঝিম সংখ্যা।
| Third Year Sixth Issue |23 rd Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
 সূচি পত্র / Index






কবিতা-শিরোনামহীন বৃষ্টি -সম্পা পাল


শিরোনামহীন বৃষ্টি

সম্পা পাল

Image Courtesy: Google Image Gallery


স‍্যাটেলাইটে সব ভাবনা ধরা পড়ে না
অথচ কটতা জরুরী

হয়তো কিছু কথা বলা যেত
কিন্তু সময়টা তখন ভিড়ের রাস্তায়

তারপর একটা বিকেল
শেষ বিকেলে পুরোনো হাইপোথিসিস

ফিরতি সন্ধ্যায় সূর্যের আলো আর থাকে না
অথচ দৈনিক ভাবি একদিন সন্ধ্যায় হাইপোথিসিস নিয়ে ঘরে ফিরবো
ভেতরের পৃথিবীতে সেদিন শিরোনামহীন একটা বৃষ্টি


সমাপ্ত



| Aleekpatamagazine.blogspot.com |
  |ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Monsoon Issue,2020 | July-September 2020 |রিমঝিম সংখ্যা।
| Third Year Sixth Issue |23 rd Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
 সূচি পত্র / Index




গল্প-মন মাঝারে-সায়ন্তনী পলমল ঘোষ


মন মাঝারে

সায়ন্তনী পলমল ঘোষ

Image Courtesy: Google Image Gallery


       " তোমার ছাতাটা একটু   সরিয়ে রাখবে প্লীজ। " জলতরঙ্গের মত কথাগুলো আকাশের কানে এসে ছুঁলোঘাড় ঘুরিয়ে কথার উৎসের দিকে তাকাতেই বুকের মধ্যে সুনামি আছড়ে পড়ল তার। হালকা বৃষ্টির ঝাঁট লাগা পনিটেল অল্প অল্প দুলছে,  ঠোঁটের নীচের তিলটা নিশ্চিন্তে বসে আছে। হরিণের মত চোখ দুটো আকাশের দিকেই নিবদ্ধ।
" প্লীজ, একটু সরিয়ে রাখনা। আমি রাখার জায়গা পাচ্ছি না।"
" হুম।" মুগ্ধতার আবেশ কাটিয়ে এরচেয়ে বেশি কিছু বলতে পারল না আকাশ।  নিজের কালো ছাতাটা সরিয়ে জায়গা করে দিল গোলাপীর ওপর লাল ফুল ছাপ ছাতাটাকে। 
   রাজেশ স্যার পড়িয়ে চলেছেন। স্যার যেদিন নতুন কিছু বোঝান সেদিন পড়াতে পড়াতে স্যার একেবারে কেমিস্ট্রির মধ্যে ডুবে যান। উনি এত সুন্দর করে বোঝান যে ছাত্র ছাত্রীরাও খুব মন দিয়ে শোনে। ওনার পড়ানোর এই দক্ষতার কারণেই ওনার কোচিং এ ভর্তি হওয়ার জন্য সবাই মুখিয়ে থাকে কিন্তু মুশকিল হল স্যার একটা ব্যাচে দশ জনের বেশি পড়ান না। ওনার ধারণা বেশি ভীড় হলে সবার দিকে সমান নজর দিতে পারবেন না তাই সবাই সুযোগ পায় না। আগে এলে আগে হবে এরকম একটা ব্যাপার।  আকাশদের এই ব্যাচে দশজন গত বছর থেকেই হয়ে গেছে। কেউ পড়া ছেড়েও যায়নি তাহলে এইচ এস পরীক্ষার  মাত্র সাতমাস আগে এই মেয়েটা ঢুকল কি করে! তারওপর ওদের ব্যাচে ওদের দশজনের সাথে স্যারের ভাইঝি শাওনও পড়ে। ওদের ব্যাচটায় শহরের বিভিন্ন স্কুলের সবচেয়ে ভালো ভালো ছেলেমেয়েরা পড়ে বলে স্যার শাওনকে ওদের সাথেই পড়ান। শাওন নিজেও অবশ্য পড়াশোনায় খুবই ভালো। এমনিতেই এগার জন এই ব্যাচে তার ওপর স্যার এই নতুন মেয়েটাকে হঠাৎ করে নিলেন কেন? আকাশ যতদূর জানে স্যার তাঁর নিয়ম ভাঙেন না কোনও দিন তা সে যত ভালো ছাত্রই আসুক না কেন। তাহলে এই মেয়েটা এমন কে? অবশ্য এই মেয়েটা আসায় আকাশের ক্ষতি তো কিছুই হয়নি শুধু বুকের বামদিকটা একটু কেমন কেমন করছে। মেয়েটাকে আগে কোথাও দেখেছে বলেও তো আকাশের মনে পড়ছে না।
" কারোর কোনও অসুবিধা থাকলে বল।" বোঝানো শেষ করে স্যার বললেন। কেউ কেউ প্রশ্ন করছে। আকাশ চুপ করে রইল কারণ আজকের অর্ধেক পড়া বাদলা হওয়ায় আকাশের কানের পাশ দিয়ে কোনদিকে যেন উড়ে গেছে।
" আকাশ কোনও প্রবলেম?"
" না, স্যার।" আকাশ মনে মনে বলল," প্রবলেম তো আছে কিন্তু আপনাকে সেটা বলা যাবে না।"
আকাশ তাড়াতাড়ি সাইকেলটা বের করল কিন্তু লাভ হল  না। মেয়েটাকে নিয়ে যেতে বাড়ির লোক এসেছিল। বাইকে চেপে চলে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশ সাইকেল নিয়ে গেটের বাইরে বেরোলো। শাওন দীপ্তির সাথে গেটের বাইরে গল্প করছে। আকাশ একটু দাঁড়িয়ে গেল।  দীপ্তি চলে যেতেই আকাশ ডাকলো," এই শাওন শোন। "
" কি?" 
" তুই সুমন স্যারের কোচিংয়ে বায়োলজি পড়িস না?"
" হুম। এটা কোনও নতুন কথা না। তুই এটা জানিস।"
" হ্যাঁ, জানি মানে বলছিলাম কি বোটানির একটা নোটস দিবি আমায়? খুব দরকার।" আমতা আমতা করে বলে আকাশ। আসলে শাওন মেয়েটা এত কাঠখোট্টা আর মেজাজী যে আকাশ ওকে রীতিমতো ভয় পায়। এমনিতে আকাশের সাথে ওর বেশ ভালোই বন্ধুত্ব আছে কিন্তু তাও ওর সাথে কথা বলতে গেলেই আকাশের বুক কাঁপে। শাওন ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট করে আকাশের দিকে তাকালো," মেয়েটার নাম নীলিমা। ওর পিসি বাড়িতে  থেকে পড়াশোনা করত। মাধ্যমিকের পর বাড়ি চলে এসেছে। এতদিন বাড়িতে কারুর একটা কাছে কেমিস্ট্রি পড়ত কিন্তু ইলেভেনের অনুয়ালে এত দারুণ নাম্বার পেয়েছে যে ওর বাবা এসে কাকুর কাছে বিশেষ অনুরোধ করে ওকে ভর্তি করে দিয়ে গেছে। আর হ্যাঁ একটা কথা ওর কাকু না লোকাল থানার ওসি। সেখান থেকেও ফোন এসেছিল তাই আমার কাকু ওকে নিতে বাধ্য হয়েছে বলতে পারিস।"
আকাশ হাঁ করে শাওনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
" মুখে মাছি ঢুকে যাবে। মুখ বন্ধ কর। তোর নোটস পেয়ে গেছিস তো এবার সাইকেলে উঠে বাড়ি যা।"
" না মানে নোটস...।"
কোমরে হাত দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো শাওন। মাথাটা ওপর নীচে দুলিয়ে চোখ পাকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল," নোটস চাই তোর! আমি পড়ি সুমন স্যারের কাছে আর তুই পড়িস তার ভাই সুদীপ স্যারের কাছে। সবাই জানে দুইভাই  একই নোটস দেয় আর তোর সুমন স্যারের নোটস চাই!  সত্যি কথা বলার হিম্মত রাখবি সব সময়। আজ কতটা পড়া শুনেছিস তুই খুব ভালো করে জানা আছে আমার। মনে মনে যা জানতে চাইছিলি বলে দিলাম এবার পালা।"
" হুম।" আকাশ তাড়াতাড়ি করে সাইকেলে উঠে পড়ল। আর এই মেয়ের সামনে থাকা যাবে না।
পরের দিনও ঝিরিঝিরি করে অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে।  রেনকোট পরতে ইচ্ছে হল না আকাশের। স্যারের বারান্দায়  রঙবেরঙের ছাতার মেলা।
" আমার ছাতাটা সরিয়ে দিচ্ছি তুমি ঐখানটায় রেখে দাও।" মিষ্টি হেসে বলল নীলিমা।  উফফ, ওই হাসিটা যেন তীরের মত বিঁধল আকাশের বুকে। এরপর থেকে প্রায়ই রাজেশ স্যারের বারান্দায় লাল ফুলছাপ গোলাপী ছাতাটার পাশে কালো রঙের একটা ছাতা শোভা পেতে লাগলো।  অন্য কোনও ছাতা ভুল করে লাল ফুল ছাপের পাশে বসে গেলেও কালো ছাতা তাকে সরিয়ে ঠিক জায়গা করে নিত। এই ব্যাচের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া ছাত্রীকে নেহাতই সহমর্মিতার কারণে আকাশ বিভিন্ন নোটস দিয়ে সাহায্য করতে লাগলো। সাধারণত সমবয়সীরা নিজেদের মধ্যে তুই তোকারী করে কথা বলে কিন্তু নীলিমা সবাইকে তুমি করে সম্বোধন করে। বাকি সবাই নীলিমার দেওয়া এই সম্মানের মর্যাদা না রেখে তাকে তুই করেই বলে কিন্তু আকাশ এসব ব্যাপারে খুব সচেতন ছেলে। সেও নীলিমাকে তুমি সম্বোধনই করে। শাওন তো একদিন সবার সামনেই নীলিমাকে দুম করে বলে বসল," এই আমরা তোর চেয়ে অনেক বড় নাকি রে? এরকম তুমি তুমি করে ডাকিস কেন রে?" আকাশ মনে মনে ভাবলো,"  তাতে তোর কি সমস্যা রে?" নীলিমা কিন্তু ভারী মিষ্টি মেয়ে তাই ঝর্ণার মত হেসে বলল," আসলে আমি কাউকে তুই বলে ডাকতে পারি না।"
" ন্যাকা।" আকাশের পাশে বসা অমিত খুব নীচু গলায় বলল। আকাশের মনে হল হাতের পেনের সূঁচাল নিবটা অমিতের পেছনে ঢুকিয়ে দেয়।  এরকম করেই চলছিল।  নীলিমার সঙ্গে আকাশের বন্ধুত্বটা বেশ গাঢ়ই বলা যায় এখন কিন্তু সেটা ওই কেমিস্ট্রি কোচিংএই সীমাবদ্ধ।  মাঝে মাঝে নীলিমাও সাইকেল নিয়ে আসে তখন তাকে মোড়ের মাথা পর্যন্ত পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়া আকাশের অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।  বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া সাহসে কুলোয় না। যতই হোক দারোগার ভাইঝি। আকাশের মনের আকাশে এখন যখন তখন নীলিমা নামের পাখিটির ওড়া উড়ি। মাঝে মাঝেই মহাকর্ষ চ্যাপ্টারে কোন অজানা এক বলের টানে নীলিমার মুখটা ভেসে ওঠে আবার কেমিস্ট্রি বইয়ে বেনজিন বলয়ের মাঝে বসে নীলিমা দোল খায়।
আকাশের মনটা আজ একটু খারাপ হয়ে গেল। নীলিমা আজ সাইকেল নিয়ে আসেনি। দাদার বাইকে চেপে রাজকুমারীর মত উড়ে চলে গেল।
" এই আকাশ শোন।" শাওন আকাশের সাইকেলের হ্যান্ডেলটা ধরে টান মারলো। শাওনের মুখের দিকে তাকিয়েই আকাশের বুকটা কেঁপে উঠল। এ মেয়ের এই দৃষ্টি আকাশ চেনে নির্ঘাত কোনও ভয়ানক বোমা ছুঁড়বে আকাশের দিকে।  ও যদি এখানে আকাশকে ধরে মারেও তাহলেও রাজেশ স্যার কিচ্ছু বলবেন না। ওনার ধারণা ওনার ভাইঝির মত মেয়ে পৃথিবীতে বিরল যে কোনও ভুল কাজ করতে পারে না।  একবার একটা ছেলে শাওনকে দেখে সিটি বাজাবে কি বাজাবে না ভাবছিল। এ মেয়ে তাকে সপাট এক চড় কষিয়ে দিয়েছিল। সেই ঘটনা নিয়ে স্যারের কি গর্ব। স্যারের স্ত্রী আবার এক কাঠি ওপরে। ওনার পরে শাওনকে মহিলা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট করবেন ঠিক করে রেখেছেন।  শাওনের বাবা মিলিটারিতে ছিলেন বলে আকাশ শুনেছে। এ মেয়েকেও সেখানেই ভালো মানায়।  ওর একটা নোটস নিয়েছিল আকাশ কিন্তু সেটা তো যথাসময়ে ফেরত দিয়ে দিয়েছে তাহলে আজ এমন মা রণচন্ডীর মত মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
" পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ফেলেছিস মনে হচ্ছে।" ভ্রু নাচিয়ে বলল শাওন।
" ক্যা ক কেন?"
" তোতলাচ্ছিস  কেন?"
" না মানে একথা বলছিস কেন?" নিজেকে একটু সামলে নিয়েছে আকাশ।
" কাকু যে চারটে সারপ্রাইজ টেস্ট নিয়েছে তাতে কত পেয়েছিস জানিস? কালই কাকু সব খাতা দেখা শেষ করেছে।"
" কত পেয়েছি?" অসহায় ভাবে প্রশ্ন করে আকাশ।
" কটা লাড্ডু পেয়েছিস সেটা জিগ্যেস কর। এত লাড্ডু খেয়ে জয়েন্ট ক্র্যাক করা যায় বলে আমার মনে হয় না।"
আকাশের মুখটা বর্ষার কালো মেঘে ছেয়ে গেল তাও  ভদ্রতা বশে জিজ্ঞেস করল," তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?"
ঘুরে তাকালো শাওন," আমি তো তোর মত ছাতা ছাতা খেলি না তাই আমার পড়াশোনা ভালোই চলছে। আয়াম শিওর আমি ভালো রেজাল্ট করবোই কারণ আমি ফিল্মের হিরোর সাথে প্রেম করলেও নিজের টার্গেট থেকে কখনই সরবো না। বুঝলি গাধা।" শাওন চলে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই আকাশ অসহায় কণ্ঠে বলল," এই শাওন শোন না। আমার বাই চান্স পরীক্ষাগুলো খারাপ হয়ে গেছে। শরীরটা ভালো ছিল না। আর ওই প্রেম ট্রেম কি বলছিস তুই আমি বুঝতে পারছি না।" 
" দেখ আকাশ তুই ভালো করেই জানিস ওই ন্যাকামি ট্যাকামি আমার সহ্য হয় না। ডিরেক্ট সত্যি কথাটা স্বীকার করার হিম্মত নেই? নীলিমার সঙ্গে প্রেম করছিস  না তুই? সত্যি কথা বল নাহলে...।" আকাশের হাত পা কাঁপছে।
শাওন যদি স্যারের কানে কথাটা তোলে আর স্যার বাবার কানে। উফফ আর ভাবতে পারছে না আকাশ।
" এই শাওন শোন না। দ্যাখ আমি স্বীকার করছি নীলিমাকে আমার খুব ভালো লাগে মানে ওর সাথে আমি প্রেম করতে চাই। খুব ভালোবাসি ওকে কিন্তু আজ পর্যন্ত বলতে পারিনি। সব সত্যি স্বীকার করছি তোর সামনে প্লীজ কাউকে বলিস না তুই। প্লীজ।"  আকাশের মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল শাওন তারপর মুখটা গম্ভীর করে বলল," তুই একটা আস্ত গাধা।"
" কেন?" আবার অসহায় বোধ করে আকাশ।
" তুই কি ভাবলি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে দিনরাত নীলিমা নীলিমা জপ করলে নীলিমাকে পেয়ে যাবি! ওর ওই দারোগা কাকু জানতে পারলে। হাজতে ঢুকিয়ে স্রেফ থার্ড ডিগ্রি দেবে কোনও এফ আই আর, কোনও চার্জ লাগবে না। বুঝলি।"  আকাশ চোখ নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের মধ্যে ভীষন একটা কষ্ট হচ্ছে। হয়ত এইজন্যই নীলিমাও কোনও দিন বেশি এগোয়নি।  ফোন নাম্বার নিলেও দরকার নাহলে একটাও ফোন করে নি অথচ আকাশের মনে হয় নীলিমা ওকে কোনও মতেই  অপছন্দ করে না।
" শোন, উচ্চ মাধ্যমিকটা ভালো করে দে। জয়েন্টে ভালো রেজাল্ট কর তারপর নাহয় নীলিমাকে প্রপোজ করে ওর হাত ধরে ঘুরিস। তোর তো মেডিকেল টার্গেট। চান্স পেয়ে যা তখন হয়ত ওই পুলিশ কাকুই তোকে থার্ড ডিগ্রীর বদলে বসিয়ে চা খাওয়াবে। তোর ভালোর জন্যই বললাম এবার কি করবি তুই দ্যাখ।" ঝাঁঝের সঙ্গে কথাগুলো বলে শাওন রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়ানো আইসক্রীমওয়ালার কাছে চলে গেল।  শাওন আইসক্রীম খাচ্ছে কেন আকাশের মাথায় ঢুকলো না।
" কি রে ফোন করে ডাকলি কেন?" শাওনের যথারীতি ডিটেকটিভদের মত সন্দিগ্ধ সুর। ইতিমধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং জয়েন্ট এন্ট্রান্স সবকিছু সাঙ্গ হয়ে গেছে। শাওনের পরামর্শটা আকাশের মনে গেঁথেছিল। তাই আবার পড়াশোনায় মন লাগিয়েছিল ফলস্বরূপ মেডিকেলে বেশ ভালো ফল হয়েছে আকাশের অবশ্য শাওন ওর চেয়েও ভালো ফল করেছে। নীলিমার মেডিক্যালে হয়নি তবে সে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পেয়েছে কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার হবে না ভালো সাবজেক্ট নিয়ে অনার্স পড়বে সেই নিয়ে দ্বন্দ্বে আছে সে। আকাশের সাথে ফোনে এইসব কথা হলেও এরচেয়ে বেশি এগোতে এখনও সাহস হয়নি আকাশের বিশেষ করে এটা শোনার পর থেকে যে ওর দারোগা কাকু ওর টিউশনের স্যারদের গণহারে ধমক দিয়ে গেছেন নীলিমা মেডিকেলে পায়নি বলে।
" কি করে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আমাকে ডেকেছিস?"
" না মানে। তুই আমার একটা কাজ করে দিবি ? প্লীজ।"
" কি কাজ?" ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল শাওন।
একটু দম নিয়ে সাহস সঞ্চয় করে আকাশ তারপর এক নিঃশ্বাসে বলে চলল,"  দ্যাখ, তোর কথা মতো আমি জয়েন্টে ভালো রেজাল্ট করেছি। তোর চেয়ে একটু খারাপ হলেও আমার রেজাল্টটাও ভালোই কিন্তু আমি সাহস করে নীলিমাকে আমার মনের কথা বলতে পারছি না। এরপর তো এডমিশন হয়ে গেলে শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। এখানে থেকেই ফোনে বলে উঠতে পারছি না আর বাইরে গিয়ে তো...। আমি তাই একটা চিঠি লিখেছি। হয়ত চিঠি ব্যাপারটা একটু ওল্ড স্টাইল কিন্তু আজও রোম্যান্টিক। এখন তো আমার নীলিমার সঙ্গে দেখা হয় না আর ফোন করে কোথাও ডাকতেও সাহসে কুলচ্ছে না। তাই এই চিঠিটা প্লীজ তুই ওর হাতে পৌঁছে দিস। তুই ওর বাড়ি গেলেও কেউ কিছু সন্দেহ করবে না। প্লীজ, শাওন এরপর তো কে কোথায় চলে যাবো। আবার কবে দেখা হবে কে জানে। বন্ধু হয়ে এটুকু উপকার কর আমার।" আকাশ শাওনের হাতটা চেপে ধরল।
" চিঠিটা দে।"
আকাশ আজ বেশ সেজেগুজে বেরিয়েছে। শাওন ওকে ফোন করে ডেকেছে একটা জায়গায়। দরকার আছে বলল। আকাশ চিঠির ব্যাপারে জানতে চেয়েছিল তাতে মেয়ে গম্ভীর স্বরে বলল," আসতে বলছি আসবি।" শাওনকে এরচেয়ে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস নেই আকাশের। যথাস্থানে পৌঁছে দেখল শাওন গম্ভীর মুখে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
" কি রে কি খবর?" উৎসাহে আকাশের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে।
" এই নে।" একটা কাগজ বাড়িয়ে দিল শাওন।
" নীলিমা চিঠি দিয়েছে?" আগ্রহ ভরে জিজ্ঞেস করল আকাশ।
" খুলে দ্যাখ।" আকাশ কাগজটা খুলে অবাক হয়ে গেল।
নীলিমা,
          অনেকদিন ধরেই বলতে চেয়েছি কিন্তু বলতে পারিনি। আমার মনের কথা মুখে এসে ভাষা হারিয়েছে কিন্তু আর নয় পড়াশোনার জন্য এই শহর ছেড়ে যাবার আগে বলে যেতে চাই, "  আমি প্রথমত তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত তোমাকে চাই, শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই।" তুমিই সেই মেয়ে যাকে দেখে আমার এই রুক্ষ হৃদয়ে বর্ষা নেমেছে। আমার মনের আকাশে ঝড় উঠেছে।  আমি তোমাকে ভীষন ভালোবাসি। তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
                                           ইতি
                                 তোমার নীল আকাশ
আকাশের চিঠিটা এরকম ছিল। এখন আকাশের হাতে যেটা আছে সেটা তারই লেখা চিঠি শুধু একটু কাটাকাটি করা। কয়েকটা  শব্দ স্রেফ একটা করে লাইন দিয়ে কেটে দিয়ে তার বদলে অন্য একটা করে শব্দ লেখা হয়েছে। এখন আকাশের চিঠির রূপ হয়েছে এরকম,
 আকাশ,
          অনেকদিন ধরেই বলতে চেয়েছি কিন্তু বলতে পারিনি। আমার মনের কথা মুখে এসে ভাষা হারিয়েছে কিন্তু আর নয় পড়াশোনার জন্য এই শহর ছেড়ে যাবার আগে বলে যেতে চাই, "  আমি প্রথমত তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত তোমাকে চাই, শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই।" তুমিই সেই ছেলে যাকে দেখে আমার এই রুক্ষ হৃদয়ে বর্ষা নেমেছে। আমার মনের আকাশে ঝড় উঠেছে।  আমি তোমাকে ভীষন ভালোবাসি। তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম না কারণ উত্তরটা আমার জানা। আমি শুধু আমার মনের কথাটা জানালাম।
                                           ইতি
                            আকাশ থেকে ঝরা শাওন
আকাশ অবাক হয়ে শাওনের মুখের দিকে তাকালো।
" তুই খুব ভালো করেই জানিস আমি রেখে ঢেকে ন্যাকামি করে কোনও কথা বলতে পারি না। মিথ্যে কথাও বলতে পারি না। এই চিঠিটায় যেগুলো লেখা আছে সব সত্যি কথা। আমি জানি তুই নীলিমাকে খুব ভালোবাসিস তাই তোর কথা ভেবে ওকে চিঠিটা দেব বলে নিয়েছিলাম কিন্তু পারলাম না।  আমি বুঝতে পারলাম আমি সিনেমা-সিরিয়ালের নায়িকাদের মত উদার হতে পারব না। যাকে আমি ভালোবাসি তার প্রেমিকাকে নিজের হাতে প্রেমপত্র দিতে পারব না আমি। তুই নিশ্চিত ভাবে জিজ্ঞেস করতিস আমি কেন চিঠিটা নিয়েও নীলিমাকে দিই নি তাই তোকে সত্যি কথাটা জানিয়ে দিলাম তবে তোর চিন্তা নেই ওই যে গোলাপী রঙের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছিস। নীলিমা ওখানে গান শিখতে এসেছে। একটু পরে বেরিয়ে আসবে। একাই এসেছে সাইকেল নিয়ে। তুই নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারবি। আমি তোর চিঠিটা নষ্ট করে ফেলেছি। এই নে কাগজ-কলম। ও বেরোতে বেরোতে আরেকটা চিঠি লিখে ফ্যাল। "
আকাশের হাতে একটা গোলাপ ফুলের ছাপ দেওয়া রাইটিং প্যাড আর পেন ধরিয়ে দিয়ে শাওন জোর কদমে সামনের দোকানটার কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকে গেল ভেতরে। কাঁচের দরজার ওপারে একটা বড়সড় আইসক্রিম নিয়ে একলা একটা টেবিলে বসে খাচ্ছে সে। আকাশ একবার সেদিকে তাকালো আর তারপর চোখ গেল গোলাপী বাড়িটার দিকে নীলিমা বেরিয়ে আসছে। তার চোখ পড়লো আকাশের দিকে। নীলিমা এগিয়ে আসছে আকাশের দিকে। আকাশও এগিয়ে গেল।
" আরে টুকটুকি তুই এত বড় হয়ে গেছিস!"
" হুম, আমি মাধ্যমিক দিয়ে দিলাম এই বছর। তুমি তো চাইল্ড স্পেশালিস্ট হয়েছ। বাড়িতে চেম্বার খুলেছ। আমি সব জানি।"
" বাব্বা, এত বিশাল ব্যাপার। টুকটুকি শাওন বাড়িতে আছে?"
" হুম, রবিবার দিদি চেম্বার বন্ধ রাখে।"
" ঠিক আছে। তুই এইটা তোর দিদিকে দিয়ে আয়। ততক্ষণে আমি স্যার আর কাকিমার সাথে দেখা করি।"
" ওকে।" টুকটুকি ভেতরে চলে গেল। রাজেশ স্যার বেরিয়ে এলেন।
" আরে আকাশ তুই! আয় আয়। কতদিন পরে এলি।" স্যার সাদর আমন্ত্রণ জানালেন। সোফায় বসার সাথে সাথে কাকিমাও এলেন," তোমার স্যার তোমাদের ব্যাচটার কথা খুব বলে।" স্যারের ছেলে বি ফার্ম পড়ছে। তার কথা, অন্যান্য টুকটাক একথা সেকথার পর আকাশ গলা ঝেড়ে বলল," স্যার, কাকিমা আমি আপনাদের একটা কথা বলতে চাই।"
" কি কথা?"
" বাবা-মা আমাকে বিয়ে করার কথা বলছে। আমি শাওনকে বিয়ে করতে চাই। বাড়িতে বলেওছি। বাবা-মার কোনও আপত্তি নেই। আমি আপনাদের মতামত জানার জন্যই আজ এসেছি।" আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বলল আকাশ। রাকেশ স্যার আর ওনার স্ত্রী মমতা দেবী খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। মমতা দেবীর চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। কোনও মতে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন," তুমি সত্যিই শাওনকে বিয়ে করতে চাও?"
" হ্যাঁ, কাকিমা। এটা তো কোনও মজা করার বিষয় নয় যে আমি এমনি এমনি আপনাদের বলে ফেললাম।"
রাজেশ স্যার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন," আসলে তোর কাকিমা শাওনকে নিয়ে সব সময় চিন্তা করে।  জানিস শাওন যখন দেড় বছরের আমার বৌদি ব্রেন টিউমারে মারা যায়। তোর কাকিমা তখন সদ্য এবাড়িতে এসেছে। ও নিজে থেকেই শাওনকে মানুষ করার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেয়। আমার দাদা তো আর্মিতে ছিলেন। বছরের বেশিরভাগ সময় বাড়িতে থাকতে পারতেন না। আমার মা আর মমতা মিলেই শাওনকে বড় করছিল কিন্তু শাওন যখন ওয়ানে পড়ে বর্ডারে জঙ্গীদের সাথে লড়াইয়ে দাদাও চলে গেল। শাওনের জন্য রইলাম শুধু আমরা। মমতার কাছে নিজের গর্ভের সন্তানদের চেয়েও শাওন আরও বেশি কিছু।"
" জানো আকাশ,  দুনিয়ার সবাই জানে শাওন খুব তেজী আর মেজাজী মেয়ে কিন্তু জন্ম না দিলেও আমি জানি আমার মেয়েটা কিরকম, যতটা শক্ত ততটাই নরম ওর মনটা। কিছু না বোঝার বয়সেই বুঝে গিয়েছিল ওর মা আর ফিরবে না কোনও দিন। কোনও দিন কান্নাকাটি করে নি। দাদা, যখন চলে গেলেন গান স্যালুটের সময় দাদার কফিনের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চোখে এক ফোঁটা জল নেই অথচ ওর মা মারা যাবার পর বাবা-মেয়ে দুজনে দুজনকে প্রবল ভাবে আঁকড়ে ধরেছিল। দাদা যখন বাড়ি আসতেন দুজনকে আলাদা করা যেত না।  সবাই অবাক হলেও আমি হইনি কারণ আমি জানতাম ও কারুর সামনে চোখের জল বের করবে না কিন্তু ভেতরে ভেতরে কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে মেয়েটা। ও ডাক্তার হয়ে গেছে তাও আমার চিন্তা হয় এমন কেউ কি  কোনও দিন ওর জীবনে আসবে যে ওকে ওর মত করে বুঝবে। সব বাবা-মাই সন্তানকে সুখী সংসারী দেখতে চায়। আজ তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে শাওন যদি এ বিয়েতে রাজী হয় তাহলে খুব ভালো হয়। তুমি অনেক ছোটবেলা থেকেই তো ওকে চেন, জানো। এমন মেয়ে কেউ কখনও দেখেছে যে মনে খুব কষ্ট পেলে কাঁদে না বসে বসে আইসক্রিম খায়। আসলে ওর বাবা যখন বাড়ি আসতেন বাবা-মেয়েতে মিলে প্রচুর আইসক্রিম খেতেন। হয়ত এভাবেই ও নিজের কষ্টে বাবাকে পাশে খোঁজে।"
আকাশ অস্ফুটে বলল," জানি।"
শাওন নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে হাতে একটা কাগজ নিয়ে। একটু আগে টুকটুকি দিয়ে গেল। আকাশ এসেছে। ওর হাত দিয়ে এই কাগজটা পাঠিয়েছে। ডাক্তারি পড়তে দুজন দুই শহরে গিয়েছিল। তারপর কালেভদ্রে খুব অল্প সময়ের জন্য দেখা হয়েছে। মাঝেসাঝে ফোনে প্রয়োজনীয় কথা হয়েছে তার বেশি কিছু না। হাতের চিঠিটার দিকে আবার তাকালো শাওন।
পাগলী শাওন,
          অনেকদিন ধরেই বলতে চেয়েছি কিন্তু ইচ্ছে করেই বলিনি। আমার মনের কথা মুখে আনার জন্য সাহস সঞ্চয় করছিলাম কিন্তু আর নয় কোনও সাহসী ছেলে এসে তোকে বিয়ে করে নিয়ে চলে যাবার আগে বলতে চাই, "  আমি প্রথমত তোকে চাই, দ্বিতীয়ত তোকে চাই, ইনফিনিটি পর্যন্ত তোকে চাই।" তুই সেই মেয়ে যে আমাকে ভালোবেসেছে কোনও শর্ত ছাড়া। ভালোবাসার জন্য ভালোবেসেছে।   আমিও তোকে ভীষন ভালোবাসি।  তুই ছাড়া সারাজীবন আমি চলতে পারব না।  প্লিজ আমাকে বিয়ে করে আমার বস হয়ে যা। তোর উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
                                           ইতি
                                 তোর ভীতু আকাশ
কথাবার্তার মধ্যেই কখন শাওন এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে কেউ খেয়াল করেনি।
" কাকু, আমি আকাশের সাথে একটু একলা কথা বলতে চাই।" শাওনের চোখ দুটো জ্বলছে।
" আকাশদার আজ হয়ে গেল।" টুকটুকি তার দিদিকে ভালোমত চেনে।
" ঠিক আছে। ওকে ভেতরে নিয়ে যা নাহলে এখানে কথা বল আমরা চলে যাচ্ছি।"
" তোমরা বস। এই আকাশ উঠে আয়।" আকাশ বাধ্য ছেলের মত শাওনের সাথে ওর রুমে এল।
" এটা কি?" ফেটে পড়ল শাওন।
" প্রেমপত্র।"
" কি ভাবিস তুই নিজেকে? কোথাকার একটা লাল হয়ে যাওয়া কাগজে কতগুলো ফালতু কথা লিখে...।" রাগে কথা শেষ করতে পারলো না শাওন।
" ফালতু কাগজ! এই রাইটিং প্যাডটা তুই আমাকে দিয়েছিলি প্রেমপত্র লেখার জন্য। এতদিনে কাজে লাগলো। ভালো করে মনে করে দেখ। চিনতে পারবি।" আজকের আকাশ যেন বড্ড বেশি সাহসী। শাওনের অগ্নিমূর্তি যেন সে উপভোগ করছে। শাওন হাতের কাগজটার দিকে তাকালো," আমি তো নীলিমাকে লেখার জন্য দিয়েছিলাম।" শাওনের কণ্ঠস্বর অনেক নিচু তারে বাঁধা এখন।
" লিখতে ইচ্ছে হয়নি তাই লিখিনি।"
" মুখেও তো ওকে কিছু বলিস নি সেদিন। আমি অবশ্য অনেক পরে জেনেছিলাম।"
" জানবি কি করে গপগপ করে আইসক্রিম খাচ্ছিলি তো তখন।"
" আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। মুখে কিছু বলিসনি কেন? সাহসে কুলোয় নি?"
" বলতে ইচ্ছে করে নি।"
" কেন? ওকে তো প্রপোজ করতেই গিয়েছিলি সেদিন? তুই তো ওকে ভালোবাসতিস।"
" কি করে বলতাম বল। সেদিনই তো তরোয়াল উঁচিয়ে ঝাঁসির রানী আমায় ভালোবাসি বলেছিল। প্রকৃত ভালোবাসা আর ইনফ্যাচুয়েশনের তফাতটা হঠাৎ করেই বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম।"
শাওন জানালার ধরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আকাশ একটু এগিয়ে গেল," সেদিন যখন তুই আইসক্রিম খেতে ঢুকলি আমার সব ওলটপালট হয়ে গেল। আমার জানতেও ইচ্ছে করল না নীলিমা আমায় ভালোবাসে কিনা। জানিস আমি সেদিন ওকে বলেছিলাম যে আমি ওখানে তোর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তুই হয়ত ভাবছিস আমি এত বছর বলিনি কেন তোকে। আসলে সেদিন তোর ভালোবাসার জন্য নিজেকে খুব ছোট মনে হয়েছিল।  পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা মনে হয়েছিল নিজেকে। ভেবেছিলাম তুই হয়ত আমার চেয়েও অনেক ভালো কাউকে পাবি। এই গাধাটার বদলে কোনও গরু খুঁজে পাবি।"
" তাহলে আজ বলতে এলি কেন?"
" তুই অনেক দিন আগেই আমাকে ফোনে জিজ্ঞেস করেছিলি যে আমি নীলিমাকে প্রপোজ করেছি কিনা। আমি এড়িয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু বাবা-মা বিয়ের কথা তুলতেই হঠাৎ মনে হল চিরকাল তুই তেজ দেখিয়ে যাবি আর আমি ভীতু হয়ে থাকব! তুই যেমন সরাসরি বলেছিলি আমায় ভালোবাসিস তেমনি আমিও বলছি তোকে আমি ভীষন ভালোবাসি। আমি তোর চেয়েও সাহসী হয়ে গেছি। নিজের বাড়িতে আর তোর বাড়িতে বলেছি যে তোকে বিয়ে করতে চাই।"
" কি বললি তুই!" শাওনের কণ্ঠে বর্ষার আগমনী।
আকাশ এগিয়ে গিয়ে শাওনকে নিজের দিকে ঘোরালো। শাওনের চোখে আজ বর্ষার ধারাপাত।
" তোর বাবার মত আমি তোকে আইসক্রিম খাওয়াব। তুই যখন খুশি হবি তখন। তোর কষ্টের সময় তুই আমার বুকে মাথা রেখে কাঁদবি। অবাক হোস না। তোর বাড়ির লোক ছাড়া আরেকজনও জানে তোর আইসক্রিম খাওয়ার কথা। অনেক বছর আগে তোর কাজকর্ম লক্ষ্য করে টুকটুকিকে চকোলেট ঘুষ দিয়ে জেনেছিল সে। তখন অবশ্য সে বোঝেনি অন্য বন্ধুদের যা কখনও খেয়াল হয়নি তার কেন খেয়াল হল। বাকিদের চেয়ে সে তোকে কেন এত ভয় পায়। শুধু তোর কথা শুনে প্রেমের চিন্তা তাকে তুলে রেখে কেন পড়ায় মন বসায়।"
শাওন আকাশের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আকাশ ওকে নিজের বুকে ভালো করে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বলল," তুই আজ মন খুলে কাঁদ শাওন। তোকে কাঁদাবার জন্যই এতদিন ধরে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করেছি।"
সমাপ্ত



| Aleekpatamagazine.blogspot.com |
  |ALEEK PATA-The Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Special Monsoon Issue,2020 | July-September 2020 |রিমঝিম সংখ্যা।
| Third Year Sixth Issue |23 rd Edition|
|© All Rights Reserved By The Editor and The Publisher |
|a DISHA-The Dreamer Initiative |
 সূচি পত্র / Index



Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান