গল্প
অংশ
তনিমা সাহা
Image Source- Internet |
নীলার আজ পরীক্ষার দিন। জীবনে
যতরকম পরীক্ষা দিয়েছে সেসব পরীক্ষা থেকেও সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এটা। নাহ্! ভয়
করছে না নীলার।
কিন্তু একদমই কী করছে না? বুকের
ভেতরটায় একটু কিন্তু দুরুদুরু করছে ঠিকই। কিন্তু এখন দুঃশ্চিন্তা করলে যে পরীক্ষা খারাপ হতে পারে!
নাহ কিছুক্ষণ চোখটা বন্ধ করে নাহয় রাখা থাক।
…
নীলা রে কী হ্যান্ডসাম একটা
ছেলে দেখলাম রে!
ওফ্…প্রিয়া! তোর কী আর
সারাদিনে কোন কাজ থাকে না?
না রে! আমি না তোর মতো অত
বোরিং হতে পারলাম না।
শোন ওটাকে বোরিং বলে না। অনেস্টি
লয়েলিটি বলে বুঝলি।
রাখ তোর অনেস্টি আর লয়েলিটি!
কী হবে ও নিয়ে! আজকালের অনেস্টির মূল্যটা আমাদের পিওন দাদাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে নে।
ক্যামেস্ট্রিতে মাস্টার্স করেও পিওনের চাকরি করছে। কেন? কারণ
পঞ্চাশ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রফেসরের চাকরিটা কিনতে পিওন দাদার অনেস্টি আর
লয়েলিটিতে আঘাত পড়েছিল।
এমন নয় যে আর্থিক ভাবে সে অসঙ্গত। বাবার টাকা থাকা সত্ত্বেও নিজের অনেস্টি আর লয়ালিটির দম্ভে
অতবড় বাড়ি ছেড়ে এসে শেষে এখানে পিওনের চাকরি করছে।
কীইই! কিন্তু প্রিয়া তুই এই
কথাটা কিভাবে জানলি?
হমহহ! নিজের দাদার সম্পর্কে
তার মায়ের পেটের বোন জানবে না তো কে জানবে?
কিন্তু তোকে তো কখনও পিওন
থাদার সাথে কথা বলতে দেখি নি!
দাদাই কথা বলে না। বলে তার
সাথে কথা বললে নাকি আমার সম্মান হানি হবে। আজ তো দেখলাম একজন নতুন পিওন দাদা এসেছে। হয়তো
অস্বস্তি এড়াতে দাদা এখানকার চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছে। জানিস যেদিন দাদা পিওনের চাকরিটা
নিলো সেদিন থেকে বাবা দাদাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। কোনরকম যোগাযোগটুকুও ছিল না। এখানেই
দাদাকে প্রায় তিনবছর পর দেখলাম।
নীলার মনে হয় দুনিয়াটা সত্যি
বড় গোলমেলে।
তার জীবনেও কী সব সুস্থির আছে? হমহহহ! যদি
স্কলারশিপটা সে না পেত তাহলে কী এই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্নটা সফল হত কখনও? পড়াশুনোয় ভাল নীলা কলেজের পড়ার খরচটা নিজের টিউশনের পয়সা
দিয়েই করেছে।
নিজের বাড়িতে নীলার অবস্থান একটা উদ্বাস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। বহুবার ভেবেছিল নীলা বাড়ি থেকে
বেরিয়ে আসার কথা।
কিন্তু কোন নিশ্চিত আশ্রয়ের জোগাড় না করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা বোকামি! শেষে এই
স্কলারশিপটা হাতে এল; যদি পি.এইচ.ডি.টা করে ফেলা যায় তাহলে
একটা চাকরি অন্ততঃ নিশ্চিত। ইউনিভার্সিটি এসে তাই নীলার একটাই ধ্যান-জ্ঞান। পড়াশুনা
পড়াশুনা আর পড়াশুনা।
প্রিয়ার বাবা তো বড়লোক! ইউভার্সিটি ভর্তি হয়েছে অনেক টাকা ডোনেশন দিয়ে। হোস্টেলে
প্রিয়া নীলার রুমমেট।
বড়লোক হলেও প্রিয়ার মধ্যে কোন অহংকার নেই। নীলার সাথে প্রিয়ার যতই মন কষাকষি হোক না কেন দিনের শেষে
সেই নীলাকেই তার সব কথা বলা চাই। তাই নীলা প্রিয়ার বন্ধুত্বটাও একটা আলাদা পর্যায়ের।
এই, এই
দেখ নীলা! সেই হ্যান্ডসাম ছেলেটা! চল গিয়ে আলাপ করি।
কথাটা বলে নীলার উত্তরের
অপেক্ষা না করেই প্রায় তাকে টানতে ছেলেটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় প্রিয়া।
হাই…আমি প্রিয়া। সোসাল
স্টাডি ডিপার্টমেন্ট। আর
তুমি?
হাই। আমি কমলেশ। ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট।
হ্যালো। আমি নীলা। সংস্কৃত ডিপার্টমেন্ট।
হাই নীলা। বসো না
তোমরা।
দাঁড়িয়ে কেন? কফি চলবে তো তোমাদের?
চলবে মানে…দৌড়ুবে।(প্রিয়া)
আলাপটা ঠিক এভাবেই শুরু হয়। পরিচয় পর্ব
সমাধা হওয়ার পর তিনজনের মধ্যে সমীকরণটাও গাঢ় আঁচে জ্বাল হতে সময় নেয় না। তিনজনের
বন্ধুত্বটাও বাড়তে থাকে দিনে দিনে। কমলেশদের বৃন্দাবনহাটিতে বিশাল পৈতৃক বাড়ি। যদিও এখন
ওখানে কেউ থাকেন না।
সবাই কাজের সূত্রে এদিক ওদিক থিতিয়েছেন। শুধু দুর্গাপুজোর সময় সবাই একসাথে পৈতৃক ভিটায় কিছুদিন
কাটিয়ে আসেন।
কমলেশের বাবা মা দুজনেই ডক্টর। প্রসার প্রতিপত্তি ভালই। তার সাথে বনেদিয়ানা ঠাটবাটও আছে। সেবারের
দুর্গাপুজোটা দুই বান্ধবী কমলেশের পৈতৃক বাড়িতেই কাটিয়েছিল। প্রিয়া যেন দিব্যি সে পরিবেশে
মানিয়ে যায়।
নীলার একটু অস্বস্তি হয়।
তার নিজেকে সেখানে বড্ড বেমানান লাগে।
পুজোর ছুটির পর কলেজ খুলে
গেছে।
ছাত্রছাত্রীরা যারা বাড়ি গিয়েছিল সব ফিরে এসেছে। নীলা জীবন থেকে 'বাড়ি' নামক জায়গা
বেপাত্তা হয়ে গেছে ততদিনে। বাড়ির লোক নীলার সাথে যোগাযোগ করতো না। নীলাও আর
আগ বাড়িয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতো না। তাই পুজোর ছুটির যে'কদিন
বাকি ছিল সেটা সে হোস্টেলেই কাটিয়েছে। যদিও প্রিয়া অনেক জোরাজুরি করেছিল তার সাথে তার বাড়ি
যাওয়ার জন্য।
কিন্তু নীলা আর নিজের অস্বস্তি বাড়াতে চায় নি।
মাস্টার্সের আর কয়েকদিন পরেই
ফাইনাল সেমিস্টার।
প্রিয়া বিভিন্ন কলেজে পি.এইচ. ডি. করার জন্য অ্যাপ্লিকেশন করতে থাকে। একদিন কলেজ
থেকে হোস্টেলে ফেরার সময় ক্যান্টিনের ফাঁকা গলিটায় নীলা প্রিয়া আর কমলেশকে একটু
ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বলতে দেখে। প্রিয়ার বুকে কোথাও যেন চিনচিন করে ব্যথা হয়। হঠাৎ ভীষণ
শরীর খারাপ লাগতে শুরু হয় নীলার। দরদর করে ঘামতে থাকে নীলা। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হোস্টেলে ঢুকে
সোজা বাথরুমে গিয়ে হরহরিয়ে বমি করে। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে নিজের রুমে এসে বিছানায় উপুর
হয়ে বালিশে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে; যাতে বাইরে
আওয়াজ না যাক।
কিছুক্ষণ পর প্রিয়া এসে দরজায় ধাক্কা দিলে নীলা বিছানা ছেড়ে উঠে নিজেকে সামলে
দরজাটা খুলে দেয়।
দরজা খুলে নীলা বলে…
আরে কী ব্যাপার। বেশ খুশি
খুশি লাগছে দেখি মহারাণীকে।
আমার কথা পরে হবে! আগে তুই বল
তোর চোখমুখের এই দশা কেন? শরীর খারাপ
লাগছে?
আরে না না। এমনিতেই
একটু টায়ার্ড হয়ে আছি।
তুই বল! হঠাৎ গালদুটো এত লালটুস লালটুস হয়ে গেছে কেন?
(লাজুক
হেসে) কমলেশ আমাকে প্রপোজ করেছে।
ওয়াও…ওয়ান্ডারফুল। আর তুই কী
বললি?
আমি 'হ্যাঁ' বলেছি।
ওয়াহ..একটা তাহলে ফাটাফাটি
বিয়ের নেমন্তন্ন পেতে চলেছি।
ধ্যাৎ তুই না…।
প্রিয়ার খুশি খুশি মুখটা দেখে
নীলা ভাবে, 'এটাই তো হওয়ার ছিল। এটাই তো
স্বাভাবিক।
আমি তো কোনদিনই সেখানে ছিলাম না। সে জায়গাটা তো সবসময় প্রিয়ারই ছিল। তাহলে…তাহলে কেন… আমার এত কষ্ট কেন
হচ্ছে? কেন আমার সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে
যেতে ইচ্ছে করছে!'
মনের দোটানার অর্থ প্রিয়ার বোধগম্য
হয় না।
দেখতে দেখতে মাস্টার্সের লাস্ট সেমেস্টারটাও শেষ হয়।
প্রিয়া জানায় যে কমলেশ
পি.এইড. ডি. করতে বাইরে যাবে। আর সে-ও ওই একই জায়গা থেকে পি.এইচ. ডি. করবে। তাই বাড়ির
লোক চাইছে তাদের দুজনের বিয়ে দিয়ে দিতে।
খবরটা শুনতে শুনতে নীলা হঠাৎ
থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করে।
কোনরকমে হাসির আড়ালে নিজের চোখের জলটা চেপে প্রিয়ার সামনে থেকে চলে আসে নীলা। দুদিন পরেই
প্রিয়া হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছিল। একমাস পরই কমলেশ আর প্রিয়ার বিয়ে। নাহ! নীলা যায় নি সে বিয়েতে। বলা ভাল সে
বিয়ে দেখার মতো মনোবল নীলা জুটিয়ে উঠতে পারে নি। পি.এইচ.ডি.র পাশাপাশি চাকরির জন্যও
চেষ্টা করছিল নীলা।
যেটা হাতে লাগে! প্রিয়া হোস্টেল ছাড়ার দিনই একটা চাকরির চিঠি পায় নীলা। ব্যস!
তারপরেই নীলা কমলেশ আর প্রিয়ার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে যায়। দেখতে দেখতে জীবনেরও ঋতু পরিবর্তন
হয়।
…
কি গো সায়নী দি এত কী ভাবছো?
আমার এক পেশেন্ট আছে জানো তো!
খুব ভাল মানুষ। সব
রিপোর্ট নর্মাল থাকা সত্ত্বেও পেশেন্টটি কনসিভ করতে পারছে না। তাই সারোগ্যাসি করতে চায়। কিন্তু
সঠিক 'বার্থ মাদার' খুঁজে
পাওয়াও যে মুসকিল!
পেশেন্টের নাম কী গো?
…
বত্রিশ বছরের নীলা এখন একজন
স্কুল শিক্ষিকা এবং বিভিন্ন এ.জি.ও. র সাথে যুক্ত। পি.এইচ.ডি.টা আর করা হয় নি তার। বিয়েটাও
করা হয় নি।
আসলে সেই একজনকেই তো পাশে চেয়েছিল সে। সে-ই যখন….।
এরপরের কাহিনী সোজা। বহুদিন পরে
প্রিয় বান্ধবীকে দেখে প্রিয়া আর কমলেশের অভিমান আর অনুযোগের বৃষ্টি অবিরত ঝরে পড়ে। তবে নীলার
প্রস্তাব শুনে প্রিয়া আর কমলেশ প্রথমে কিছুতেই রাজি হতে চায় নি।
কিন্ত নীলা তাদের দুজনকে
বুঝিয়ে বলে, 'আমি তো তোদের বন্ধু। এক বন্ধুর
ক্রাইসিসে আরেক বন্ধুকে কাছে থাকতে দে প্লিজ। আমি তো তোদের বিয়েতে কোন উপহার দিতে
পারি নি।
ভেবে নে না তোদের জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটা না হয় এই বন্ধু থেকেই পেলি।'
কমলেশ আর প্রিয়া এরপর আর
আপত্তি করে নি।
…
ম্যাডাম চলুন।
হ্যাঁ চলুন সিস্টার।
হাসপাতালের ম্যাটার্নিটি
ডিপার্টমেন্টের কোনার কেবিনটায় সোফায় বসে নীলা পুরোনো কথাই মনে করছিল। সিস্টারের
ডাকে আবার সে বাস্তবে ফিরে আসে। ছোট থেকে সব পরীক্ষাতেই নীলা সফলতার সঙ্গেই উত্তীর্ণ হয়েছে। তার
বিশ্বাস এই পরীক্ষাটাতেও সে উত্তীর্ণ হবে। আধঘন্টা পরে ও.টি.র বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা উদ্বিগ্ন প্রিয়ার
কোলে যখন ছোট্ট পরীটাকে দেওয়া হল তখন প্রিয়ার চোখের বাঁধ আর মানলো না।
কমলেশ দেখো..দেখো..আমাদের
সন্তান।
আমরা পেরেছি।
আমরা আমাদের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পেরেছি।
হ্যাঁ, প্রিয়া।
দুজনের চোখ বেয়ে বয়ে চলে
আনন্দাশ্রু।
একটু সামলে কমলেশ সামনে
দাঁড়িয়ে থাকা সিস্টারকে বলে, 'সিস্টার
নীলা..নীলা কেমন আছে?'
সিস্টার হেসে বলেন, 'উনি একদম ঠিক আছেন স্যার। তবে আমাদের মিষ্টি খাওয়ানোর
ব্যাপারটা কিন্তু মাথায় রাখবেন।'
কমলেশ হেসে বলে, 'নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।'
দেখতে দেখতে কেটে যায় দুমাস। নীলা এখন
কয়েকদিন প্রিয়ার কাছেই থাকছে। খানিকটা প্রিয়ার জোরের জন্য আর খানিকটা…। ছোট্ট
পরীটা দেখতে অনেকটা নীলার মতো। একদিন সকালে প্রিয়া নীলার রুমে এসে দেখে রুমে কেউ নেই। বাইরেও কোথাও
নেই।
নীলাকে ডাকতে ডাকতে প্রিয়া বাড়ির বাইরে পর্যন্ত খুঁজতে আসে। নাহ্! কোথাও নেই নীলা। হন্তদন্ত
হয়ে প্রিয়া কমলেশকে ডাকতে আসে। ঘরে ঢুকে দেখে কমলেশ বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ছোট্ট পরী
তখন সারারাত পাহারা দিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন।
শুনছো! নীলাকে কোথাও পাচ্ছি
না।
নীলা চলে গেছে প্রিয়া। চিরতরে..।
কমলেশ একটা ভাঁজ করা কাগজ
প্রিয়ার হাতে ধরিয়ে দেয়।
যাতে লেখা ছিল,
'ভাল
থাকিস তোরা দুজনে
ভাল থাকিস দুজন আজীবনে।'
ইতি
অভাগী
নীলা
তুমি এটা কোথায় পেলে?
আমার মাথার বালিশের পাশে।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর প্রিয়া
বলে, ' নীলা তোমাকে খুব ভালবাসতো কমলেশ। তাই হয়তো
ভালবাসার মানুষটির জন্য সে নিজের প্রাণভোমরাকে দিয়ে দিতে এক বারের জন্যও ভাবে নি।'
কমলেশ হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলে, 'সারাজীবন ধরে ভাল থাকার উপায় খুঁজতে খুঁজতে হয়তো ভাল থাকার
আস্তানা শেষে খুঁজে পেয়েছে নীলা। হয়তো সে তার অংশকে রেখে যেতে চেয়েছিল আমাদের মাঝে। হয়তো
এভাবেই সে ভাল থাকতে চেয়েছে। ভালবাসা যে স্বার্থ দেখে না প্রিয়া! সে তো শুধু ভালবাসতেই
জানে।'
| ALEEK PATA- Your Expressive World | Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Bengali New Year 2024 | April-24 | Seventh Year First Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| Published By : Aleek Publishers- www.aleekpublishers.com |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |