অলীক পাতার অন্যান্য সংখ্যা- পড়তে হলে ক্লিক করুন Library ট্যাব টি



। । "অলীক পাতা শারদ সংখ্যা ১৪৩১ আসছে এই মহালয়াতে। । লেখা পাঠানোর শেষ তারিখ ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টা ।.."বিশদে জানতে ক্লিক করুন " Notice Board ট্যাব টিতে"

Showing posts with label ভ্রমণ. Show all posts
Showing posts with label ভ্রমণ. Show all posts

Monday, December 24, 2018

আমার বেলা যে যায়-বর্ণনা বসু


আমার বেলা যে যায়



Picture Courtesy: Google Image

কখন যে চোখ লেগে গেছেবুঝতেই পারিনি.
চোখ খুলেই দেখি গীতবিতান টা পাশে ড়ে গেছে আর ভেতরে বুকমার্কটা হারিয়ে গেছে.

আজ অনেকদিন পর হঠাৎ ইচ্ছে হলো পূজা পর্যায়ের গানগুলিতে একটু চোখ বুলিয়ে গুনগুন করি। সংসারসন্তান আর নিজের হাজারটা কাজের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ  যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছেনআবছা হয়ে যাচ্ছেন এখনও দৈনন্দিন জীবনে গতে বাঁধা নিয়মের মাঝে ভাবিএকটা মানুষের মধ্য এত ব্যপ্তি আসে কিভাবে।। প্রতিটা ঋতু প্রতিটা মুহুর্তের জন্য গানকবিতা ও নৃত্যনাট্যের রচনা করে গেছেন।

কখনও ভানুসিংহের পদাবলিতে রাধাকৃষণের রাসলীলাআবার কখনও মায়া কুমারীদের মায়ার খেলা।

 একটা ব্যপার লক্ষ্য করেছি যে আমার মত বাঙালীর সমস্ত কিছুতে রবীন্দ্রনাথ ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছেন।

আহা তোমার সঙ্গে প্রানের খেলা...










চিত্রঋণঃগুগল ইমেজ  
পত্রসজ্জাঃস্বরূপ চক্রবর্তী













Tuesday, October 9, 2018

ভ্রমন-সান্ত্বনা দাস


 মর্ত্যের দেবভূমি বদ্রীনারায়নের পথে 

বদ্রীনাথ ধাম



      ঈশ্বর আর কতদূর, আর কতদূরে গেলে তোমায় দেখতে পাব? ক্লান্ত পথিক ভয় বিস্ময়ে ডুকরে ওঠে মনে মনে। "এই তো আর একটু, আর একটু পাহাড় ডিঙ্গিয়ে নদী পেরিয়ে গহন বরফ রাজ্যের ভেতর দিয়ে আয় "।এই কি ঈশ্বরের ভাষা না এগিয়ে যাবার অমোঘ টান! জানি ভয় পেলে যাত্রা কঠিন হবে। অলকানন্দার পাশ দিয়ে সঙ্গম ছুঁয়ে আমাদের যাওয়ার কথা। অদম্য ইচ্ছা আর সাহস নিয়ে শুরু হল পথ চলা। 
      আমাদের ছ'জনের দল। চক্রবর্তীদা, ভট্টাচার্যদা তাঁর স্ত্রী,সেন বৌদি আর দাসবাবু আর আমি। ২০১৫ তে ২০ শে মে আমরা ক'জন যাত্রা করলাম হিমালয়ের উদ্দেশ্যে। পিছনে পড়ে রইল পরিচিতজনদের বিস্মিত চাউনি আর প্রিয়জনদের উদ্বেগ। বেশী দূরের কথা নয়, ঘটে গেছে সেই দুর্যোগ কেদারনাথ আর এই সমস্ত পাহাড়ী অঞ্চলে। ভেসে গিয়েছিল কেদারনাথের জনপদ। ভেঙ্গে পড়েছিল পাহাড়। বদ্রীনাথের পাহাড়, জনপদ রাস্তাঘাট হয়েছিল পাব্লিত আর বিপদসঙ্কুল।
    বুধবার ট্রেন ছিল ১ টা ১০এ। রওনা দিলাম হাওড়া থেকে হরিদ্বারের দিকে। লক্ষ্য বদ্রীনারায়ন হয়ে গঙ্গোত্রী ইত্যাদি।


     এক রাত দু'দিন কাটিয়ে পৌঁছলাম হরিদ্বার। হরিদ্বার কথাটির দু'টি অর্থ হয়। কৈলাশ হল ভগবান শিবের বাসস্থান। কৈলাশ যাবার প্রথম দ্বার হল হরিদ্বার, অর্থাৎ হর-দ্বার। আবার আর এক অর্থে বদ্রীনারায়নের অর্থাৎ ভগবান বিষ্ণুর বাসস্থান হল উত্তরাখণ্ড ,সেই কারনে হরির বাসস্থানে যাবার এটাই প্রথম পথ। এখানে আমরা হর কি পৌড়ির ঘাটে সেই রাতে প্রিয়জনের মঙ্গল কামনায় প্রদীপ ভাসালাম। মা গঙ্গা এবং অন্য দেব দেবীর মূর্তি দর্শন করলাম। কল্লোলিনী গঙ্গা যেন পরম স্নেহে আমাদের স্পর্শ নিলেন। পথের কষ্ট ভুলে আমরা তৃপ্ত হলাম, স্নিগ্ধ হলাম। ট্রেন যাত্রার অসহ্য গরম আর ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে গেল। হরিদ্বারে অনেক ঘাট,হর কি পৌড়ি, বিষ্ণুঘাট,রাম‌ঘাট ইত্যাদি। 
হলি ডে হোমে এক রাত কাটিয়ে পরদিন কংখল যাত্রা করলাম। কংখলে আনন্দময়ী মায়ের সুন্দর শ্বেত পাথরের মন্দির আছে। শোনা যায় কংখলেই নাকি রাজা দক্ষ যজ্ঞ করেছিলেন এবং এরই কাছে
সতী দেহত্যাগ করেছিলেন। সেই সন্ধ্যায় আমরা বর্ণময় গঙ্গা আরতি দেখলাম। সংস্কৃত মন্ত্র এবং দীপ নিয়ে গঙ্গাবক্ষে আরতি, সুন্দর দৃশ্য। দীপের আলো আর খেয়াদীপের আলো, দুয়ে মিলে এক অদ্ভূত সুন্দর দ্যুতি নদীবক্ষে দীপ্তিময় হল। ২৩ তারিখ সকালে আমরা যাত্রা করলাম বদ্রীনারায়নের পথে।


        একটা টাটা সুমো আমাদের বাহন আর আশীষ আমাদের ড্রাইভার। 

হরিদ্বার থেকে বাঁধানো সুন্দর পথ,গাড়ী চলল হু হু করে। কথা গল্প আর দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন পেরিয়ে এসেছি অনেকটা পথ। বাঁধানো পথ শেষ হয়ে গেছে ।ওপরে উঠতে শুরু করেছি পাহাড়ের গা বেয়ে। দূর থেকে মনে হচ্ছে পাহাড়ের পর পাহাড় দিয়ে তাসের মত সাজিয়ে রেখেছে কেউ পুরো জায়গাটা। আলো ছায়ায় মায়াবী সে দৃশ্য। ক্যামেরায় বন্দী করলাম সে দৃশ্য যতটুকু পারলাম। আমরা এগিয়ে চলেছি দেবপ্রয়াগের দিকে। শিবালিক হিমালয় থেকে যত নদী নেমে এসেছে, সবকটি একত্রিত হয়ে  মিলিত হয়েছে দেব প্রয়াগে। ঋষি, অলকানন্দা, বিষ্ণু,ভাগীরথী, পিণ্ডার, নন্দাকিনী, মন্দাকিনী, সরস্বতী, শ্যেন, কেদার, গঙ্গা, অসি, বরুণা ও ধৌলী এই কটি নদী একত্রিত হয়ে অলকানন্দা ও মন্দাকিনী নাম নিয়ে দেব  প্রয়াগে মিলিত হয়েছে। কথিত আছে সব দেবতারা এখানে স্নান করেছিলেন।১৯৯৩ সালে যখন প্রথমবার বদ্রীনারায়ন যাই তখন এই পবিত্র জল স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়ে ছিল, এবারে স্পর্শ হল না এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। পাহাড়ের পথ সঙ্কীর্ণ ধূলি ধূসরিত। কোথাও আবার সামান্য পরিস্কার। গাড়ী চলতে লাগল, ক্যামেরাও। এ এক অদ্ভূত অনুভূতি। একেই বুঝি বলে পাহাড়ের টান। 
তখনও ধ্বংসের রূপ চোখে পড়ে নি। পৌঁছে গেলাম রুদ্রপ্রয়াগ। ১৯৯৩ সালে রুদ্রপ্রয়াগকে দেখেছিলাম অন্য রূপে। পাহাড়ী সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে গেলে রুদ্রদেবের মন্দির ,শিবমন্দির উঁচুতে। একটুখানি নীচে দূর্গামন্দির,সেখানে মাতাজী পূজারিনী। কথা বলেন না। ইশারায় আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। সামনে পাথরের চাতাল রেলিং দিয়ে ঘেরা। প্রকাণ্ড এক শীলা তীব্র জলস্রোতের মধ্যও স্থির হয়েছিল। সবাই বলে 'নারদশীলা ',দেবর্ষি নারদ এর ওপর বসে তপস্যা করেছিলেন। এত কথা বললাম কারন যাওয়ার সময় না পারলেও আসার সময় রুদ্রপ্রয়াগে নেমেছিলাম এবার ।বিপর্যয়ের সময় জলের তাণ্ডবে ভেসে গেছে নারদশীলা, ভেঙ্গে গেছে রেলিং। রাস্তা ভাঙ্গা। ধ্বংসের রূপ প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম এখানে। দুর্গা মায়ের মন্দিরে বৃদ্ধা পূজারিনীকে মায়ের সেবায় দেখলাম। জিজ্ঞাসা করা হয়নি 'আপনিই ২১ বছর আগের দেখা সেই পূজারিনী নাকি? তাই যদি হয় এই প্রয়াগ যখন  ফুঁসে উঠেছিল কোথায় ছিলেন আপনি? 'প্রসাদ পেলাম। আবার যাত্রা শুরু।


                  চামলী হয়ে আমরা এগিয়ে চললাম যোশীমঠের দিকে। যোশীমঠে বদ্রীনারায়ন ছ'মাস পূজিত হন।পথে পড়ল বড় বড় বোল্ডার আর অজস্র ভাঙা পাথর। পাশে পাশে চলল অলকানন্দা পথ দেখিয়ে। পাহাড়ের আরও ওপরে উঠছি আমরা। একপাশে পাহাড় আর একপাশে বিশাল খাদ। পৌছে গেলাম যোশীমঠে। বৃষ্টি নেমেছে পথে, চারিদিকে নিশ্চুপ অন্ধকার। বিশেষ ছাউনি কোথাও নেই। আমাদের গন্তব্য কালী কমলী রেস্ট হাউস. গাড়ী থেকে নেমে ভিজে গেলাম আমরা। ব্যাগ জামাকাপড় সব ভিজে গেল। রাত ৯ টা বাজে। রেস্ট হাউস জানিয়ে  দিল  book করা থাকলেও এত রাতে ঘর পাওয়া যাবে না। অনেক কষ্টে পাশের হোটেলে ঘর মিলল।আস্বাস্থ্যকর এবং রাত্রি যাপনের অযোগ্য। খাদ্য যা মিলল তা মুখে দেওয়া যায় না। প্রায় অভুক্ত রাত কাটল। সকালে উঠে বরফ ঘেরা ছোট্ট শহর দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। গুরু শঙ্করাচার্যের তৈরী চারটি জ্যোতির্মঠের মধ্যে এটি একটি। সামান্য কিছু খেয়ে আবার যাত্রা শুরু। মাঝখানে গাড়ী থেকে নেমে আউলিতে একটু সময় কাটালাম। বরফ ঢাকা পাহাড়ের দৃশ্য অতি মনোরম। মাঝে একটুখানি সমতলে আমরা দাঁড়িয়ে। পাহাড়ের অনেক ওপরে হনুমানজীর মন্দির। প্রণাম করলাম। আউলির ফটো তুললাম। আবার যাত্রা শুরু। 

                  এবার বিষ্ণুপ্রয়াগ। বিষ্ণুগঙ্গা আর অলকানন্দার সঙ্গমস্থল। এপার ওপার একটা ঝুলনা। ঝুলনায় পা দিতেই দুলে উঠল। অনেকেই ভয় পেল কিন্ত ফটো উঠল ক্লিক ক্লিক।পথ চলতে চলতে পান্ডুকেশ্বরও পেরিয়ে এলাম। এবার যাত্রা বিশাল বদ্রীনারায়নের দিকে। 
                  পথ সঙ্কটময়। পাহাড়ের গায়ে সরু পথ 
একটা গাড়ী কোন রকমে যেতে পারে কিন্তু চাকাটা খাদের দিকের রাস্তায় একদম লাইন বরাবর যাচ্ছে। ঝুরঝুরে পাথর সব সময়েই খসে পড়ার আশঙ্কা। খাদের নীচে দিকে তাকানো যাচ্ছে না। এদিকে যখন তখন পাহাড়ের মাথা থেকে বড় বড় পাথরের চাঁই গড়িয়ে পড়তে পারে। সরু পথের উল্টোদিক থেকে যখনই গাড়ী আসছে তখনই বিপত্তি। যার চাকাটা এক ইঞ্চি সরে যাবে তার কি হবে তার নমুনা আমরা দেখলাম ।গভীর খাদে একটা গাড়ী উল্টে পড়ে আছে, বোল্ডার পড়ে আরও দু'টো গাড়ী ধ্বংস হয়ে গেছে। অতএব বহু দূর থেকে গাড়ী আসতে দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়া অপেক্ষাকৃত একটু চওড়া জায়গায়, কোন পাহাড়ের বাঁকে ।কোন কোন জায়গায় দু'পাশে বরফ ঢাকা পাহাড়  পায়ের নীচে সরু পথ বরফে মোড়া। বরফ আর বরফ শুধুই বরফ। পরিস্কার আকাশ যখন, সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে রুপালী চূড়ার ওপর। বরফের রাস্তা পার হতে না হতেই আবার প্রলয়ের চিহ্ন। প্রবল বিপর্যয়ের পর ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত এই পথ। খসে পড়েছে বড় বড় পাথর। কাল পড়েছে, আজ পড়ছে হয়ত কালও পড়বে। হয়ত নয় পড়বে, এটাই পাহাড়ের প্রকৃতি। এই ধ্বংস অব্যাহত চিরন্তন। গায়ে শিহরন দেয় তবু চোখ বন্ধ করতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় এই ছবি ধরে রাখি মনের ফ্রেমে। 
ফটো উঠল মনে, ফটো উঠল ক্যামেরায়। 
                                                   

     এক জায়গায় আমাদের গাড়ীর সামনেই ধ্বস নেমেছে। দাঁড়িয়ে গেল গাড়ীর লাইন। কিছুক্ষন লাগল ধ্বস পরিস্কার হতে, আবার আগের মতো চলল  গাড়ী গুটি গুটি পায়ে। কোথাও পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে নদীর মতো বরফের স্রোত, আবার কোথাও বিশাল বিশাল বৃক্ষ। অপূর্ব দৃশ্য দেখে চোখ ফেরে না। পাহাড়ের পর পাহাড়, তার ওপরে পাহাড়, পেছনে পাহাড় সামনে দুদিকে পাহাড়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় পথ বন্ধ। না পথ আছে ,বিশাল বদ্রীনারায়নের দিকে গেছে ,মর্তের স্বর্গের দিকে। কোথাও কোথাও সূর্য্যের আলো পড়ে রুপোর মতো ঝকঝক করছে পাহাড়।পাহাড় আর পাহাড়, পাহাড় আদি পাহাড় অনন্ত। এদের চূড়া আকাশচুম্বী, নীচে অসীম খাদ যার শেষ দেখা যায় না। যদি জিজ্ঞেস করি "ঈশ্বর তুমি কোথায়? "কান পাতলে হয়তো শুনতে পাব "এই এখানে তোর পাশে, তোর কাছে,তোর নিশ্বাসে, তোর অনুভবে নইলে এই দুর্গম স্থানে তুই এলি কি করে? "


চড়াই উৎরাই পেরিয়ে পৌঁছুলাম দেবভূমি বদ্রীনারায়নে ,আশ্রয় মিলল কালীকমলী  রেস্ট হাউস এ। সামনে নীলকণ্ঠ পাহাড়,বরফে ঢাকা সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ।সূর্যের আলো পড়ে অপূর্ব তার দ্যুতি।দুপাশে দুই শৃঙ্গ নর ও নারায়ণ, ঘিরে রয়েছে নীলকণ্ঠকে। ২১ বছর আগের দেখা নীলকণ্ঠ আরও একবার আমাদের বিমোহিত করল। বন্ধুদের  জন্য ধরে রাখলাম সেই ছবি, কোথাও সূর্যোদয় কোথাও বা সূর্যাস্ত,কোথাও কলকল পাহাড়ী নদী কোথাও আবার সঙ্গমের স্রোত। বেলা ১২ টা নাগাদ পৌঁছুলাম বদ্রীনারায়ন। মন্দিরের কাছেই ব্রম্ভকুণ্ড, প্রচণ্ড গরম জল। সাধ্যমত স্নান সেরে পূজোর ডালি নিয়ে দাঁড়ালাম পূজো দেওয়ার লাইনে। লাল রঙের মন্দির। বিধ্বংসী বন্যায় কেদারনাথ মন্দিরের যেমন ক্ষতি হয়নি বদ্রীনারায়ন মন্দিরেরও তেমন ক্ষতি হয় নি। ঢুকলাম মন্দিরের গর্ভগৃহে। পরমপ্রাপ্তি। সর্ব আভরণে ভূষিত ঐশ্বর্যময় অপূর্ব নারায়ণ মূর্তি। দেখা যেন শেষ হয় না। মনে আকাঙ্খা হয় আরও দেখি। পূজো দিয়ে মনে মনে প্রার্থনা জানালাম। ফিরে এলাম রেস্ট হাউস এ। বৃষ্টি আরম্ভ হল, পাহাড়ী বৃষ্টি যখন তখন হয় ,সঙ্গে তীব্র শীত। খাওয়া শেষে সবাই কম্বল মুড়ি দিলাম। 
                                

      পরদিন মানাগ্রাম।ভারতবর্ষের হিমালয় পর্বতমালার সীমার শেষ গ্রাম। ২১ বছর আগের বোল্ডারের ওপর দিয়ে হাঁটা নয়, এখন রাস্তা বাঁধানো কিন্ত চড়াই উৎরাই তো আছেই। পথের পাশে পাশে দু'একটি করে দোকান, এগিয়ে চললাম পায়ে পায়ে। সামনে পেলাম সরস্বতী গঙ্গা, সরস্বতী নদীর উৎসস্থল।তীব্র ভয়ঙ্কর উত্তাল জলচ্ছাস পাহাড়ের মাথা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নীচে। অপূর্ব শোভা। পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে বয়ে আসা জল মাথায় মুখে দিলাম,স্পর্শ করলাম সরস্বতী গঙ্গা। এরপর ব্যাস গুহা। অন্ধকার গুহার মধ্যে ব্যাসদেবের মূর্তি। কথিত আছে ব্যাসদেব এখানে বসেই পুঁথি রচনা করেছিলেন। ফিরে এলাম রেস্ট হাউস এ। পরদিন আবার যাত্রা, এবার লক্ষ্য গঙ্গোত্রী। 
                  

       পরদিন সকালে যাত্রা শুরু রুদ্রপ্রয়াগের দিকে।পথের নেশা আর যাত্রা পথের ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে পরলাম। রুদ্রপ্রয়াগে এক দিন কাটিয়ে রওনা দিলাম উত্তরকাশীর দিকে। রেস্ট হাউস এ পৌঁছলে এখানকার সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করল। ঘরের পিছনেই গঙ্গা। বড় শহর,বড় জায়গা। সন্ধ্যাবেলা গঙ্গার তীর অতি মনোরম। কিন্ত টিপ টিপ করে বৃষ্টি তো পড়েই যাচ্ছে। এক অজানা আশঙ্কা যে মনে দানা বাঁধছে না  তা নয়  ,পথ যা দুর্গম বেরিয়ে গঙ্গোত্রী পৌঁছতে পারব তো? যেকোনো সময়েই তো  ধ্বসে রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বাড়ীতে ফোন করে বলে দিলাম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে যেন চিন্তা না করে। অতঃপর সেই পায়ে চলা রাস্তায় গাড়ী চলা,সন্তর্পণে  ধীরে ধীরে দেখে দেখে। সেই বরফের চাদর ঢাকা সরু পথ। পায়ের নীচে খানিকটা পথ ধাতব কিছু পাতা, ‌তার ওপর বরফের চাদর জমে আছে। দুরে এক জায়গায় ছোট ছোট বিন্দুর মতো দেখাচ্ছে, ছাগল চরে বেড়াচ্ছে।কোথাও ঝাউ গাছের মতো গাছের সারি,  কোথাও আবার নীচে দিকে পাহাড়ের গা কেটে ছোট ছোট ক্ষেত। অবশেষে পৌঁছুলাম গঙ্গোত্রী।প্রায় মন্দির সংলগ্ন রেস্ট হাউস  এ আমরা উঠলাম। মন্দিরে গঙ্গা মায়ের পুজো দিয়ে নীচে নেমে  স্পর্শ করলাম পূণ্যতোয়া গঙ্গা। এবার এগোলাম গঙ্গোত্রীর উৎসমুখ সূর্যকুণ্ডের দিকে। পাহাড়ের  ফাঁক দিয়ে বিপুল বেগে আলোড়িত হয়ে গঙ্গা ঝাপিয়ে পড়ছে পাতালে। বিচিত্র রঙের পাথর ঘিরে রয়েছে স্রোতস্বিনীকে। বেগবতীর গর্জন,বেগ, কল্লোল আর গান সবই যেন আপন মহিমায় বিচ্ছুরিত হচ্ছে। আমরা তৃপ্ত, আমরা ধন্য। রাত্রিবেলা মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি দেখে বিশ্রাম। 

পরদিন ফেরার পালা। পৌঁছুলাম হরিদ্বার।লছমন ঝুলা
, রামঝুলা ইত্যাদি দেখলাম। কেউ কেউ মনসা মন্দির, চণ্ডী মন্দিরও দর্শন করে এলেন। একদিন কাটিয়ে হাওড়ার ট্রেন ধরলাম। 

ছবি তুলেছেন ঃ লেখিকা






পত্রসজ্জাঃস্বরূপ চক্রবর্তী



















Friday, August 17, 2018

যখন তখন-ভ্রমণ-কালাপানির দেশ আন্দামান (পর্ব-৪ )-তৃপ্তি মিত্র

কালাপানির দেশ আন্দামান (পর্ব-৪)

তৃপ্তি মিত্র 

সংখ্যা -২৬, (১৭ ই আগস্ট , ২০১৮)



যথা সময়ে ডিগলিপুর পৌঁছে গেলাম ৷ অতীতের পোর্ট কর্নওয়ালিস হল বর্তমানের " ডিগলিপুর " ৷ অঞ্চলটি বাঙালি অধ্যুষিত ৷ এখানকার নাম করা হীরা হোটেল বাঙালি পর্যটকদের খুব প্রিয় ৷ গাইডের কথা মতো এখানেই প্রাতরাশ সারলাম হিংএর কচুরি ছোলার ডাল সহযোগে ৷ প্রাতরাশেই বাজি মাত ওফ কি অপূর্ব তার স্বাদ ৷ যেন কোলকাতার শ্রীহরির সেই চেনা স্বাদ ৷ এ অভিজ্ঞতা আমাদের বাঙালিদের জীবনে ঘটে নি হলফ করে বোধহয় কেউ বলতে পারবে না  ৷ বিদেশ বিভুয়ে ঘুরতে গিয়ে চেনা পরিচিত স্বাদ খুঁজে পাওয়া মানে হাতে চাঁদ পাওয়ার সমান ৷ যাইহোক দিপ্রাহরিক খাবারের অর্ডারও করে দিলাম ৷ দুপুর একটা দেড়টার মধ্যে চলে আসবো কথা দিয়ে সোজা চলে গেলাম " রস ও স্মিত "  আইল্যান্ড ৷ 
প্রতিবারের মত আধার কার্ড দেখাতে হয় সঙ্গে যে কয়জন আছি সবারই ৷ আমরা মোট আটজন ছিলাম , দুটো স্পিড বোট পেলাম , এক একটি বোটে চারজন ৷ নিয়ম মাফিক লাইফ জ্যাকেটে সবাই সেজে উঠলাম  ৷ আমাদের আগে আরো বেশ কয়েকটি বোট রওনা দিল ৷ সবকটি বোটই নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলছে ৷ এ কয়দিনে সমুদ্র আর বোটকে খানিকটা আপন করে ফেলেছি ৷ বোটে যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম দুদিকে দুটো আইল্যান্ড মনে মনে ভাবছি এখানে কি এমন দেখার আছে ৷ সে ভ্রম ভাঙ্গল খানিক পরে ৷ বোট অনেকটা আগে আমাদের নামিয়ে দিল মানে যতটা জল ছিল ৷ এরপর বালির চরা হেঁটেই এগোছি দূরে রোপোলি বালুর পাহাড় ৷ বালুপাহাড়ে এসে যা দেখলাম জানিনা কতটা ভাষায় প্রকাশ করতে পরবো ৷ এখানের জলের সোভা দেখলে মন প্রাণ সব জুড়িয়ে যাবে ৷ কি অপরূপ তার সোভা ৷ খুব কাছে সবুজ , একটু দূরে ফিরোজা ,আরো দূরে তিব্র কালচে নীল ৷ এরপর আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল মিঁলেমিশে একাকার ৷ কোনটা সমুদ্রের নীল কোনটা আকাশের নীল আলাদা করার উপায় নেই ৷ অনেকক্ষন ধরে সমুদ্র স্নান করলাম ৷ চেঞ্জরুম আছে যদিও তেমন উন্নত মানের কিছু নয় ৷ যাইহোক পাওয়া গেল এটাই সান্তনা ৷ 

কথা মতো হিরা হোটেলে ফিরে দূপুরের আহার আলুরচোখা , ডাল , পার্সে মাছের ঝাল সঙ্গে দেশি মুরগি ৷ খুব চেটে পুটে খেয়ে মন ভরে গেল ৷ সঙ্গে উপরি পাওনা যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যাওয়া আমার এক দিদিকে পেলাম ৷ মাধ্যম একটা ফোন নাম্বার দিদিকে শেষবার দেখেছি আমি তখন ক্লাস ওয়ান হব হয়ত ৷ ফোনে কথা অনুযায়ী জামাইবাবু হিরা হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ায় ৷ ওখান থেকে দিদির বাড়ি ৷ এরপর যা হয় দিদি বোন গলা জড়িয়ে অঝোরে কান্না ৷ কত গল্প , হাসাহাসি ৷ রাত্রে বিশেষ কিছু খাব না জাননো সত্বেও দিদি , জামাইবাবু ছাড়ল না ৷ রাত্রে  "বি . ডি " লজে ফিরতেই হল ৷ কারণ পরবর্তী গন্তব্য  " হ্যাভলক " ৷ দিদির কান্না ভেজা মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো ৷ দিদির তিন মেয়ে কারোর সঙ্গে দেখা হল না ৷ বড় ,ছোট মেয়ে পোর্টব্লেয়ারে থাকে পড়াশুনার জন্য ৷ মেজো কোলকাতায় এমফিল পড়ছে ৷ আন্দামানের প্রতিটি স্কুল কেন্দ্রীয় মধ্য শিক্ষা ( C.B.S.E ) দ্বারা অনূমোদিত ৷ মহাবিদ্যালয় গুলি পন্ডিচেরি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পলিটেকনিক মহাবিদ্যালয় নিউদিল্লী দ্বারা অনুমোদিত ৷ ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়াশুনা এখানে বাধ্যতামুলক  ৷ 

আন্দামান ভ্রমনে ট্যুর এজেন্সির সাহায্য নেওয়াটাই শ্রেয় ৷ আমাদের এজেন্সির তত্বাবধানে ম্যাক্রুস জাহাজে চেপে হ্যাভলকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ৷ সমুদ্রের সোভা দেখতে দেখতে দু ঘন্টার মধ্যে হ্যাভলক পৌঁছে গেলাম ৷ এটি মুলত দেশ ভাগের সময় সর্বস্ব হারানো বাংলা দেশি মানুষের উপনিবেশ ৷এই দ্বীপটি সকল পর্যটকের অত্যন্ত প্রিয় ৷ এখানের " রাধানগর "   বিচ ২০০৪ সালে বিশ্বের সেরা বিচে সন্মানিত হয় ৷ দিগন্ত বিস্তৃত নীল জলরাশি , শুভ্র বালুতট এই বিচের সৌন্দর্য্য কে করে তুলেছে আরো মোহময়ী ৷ জলের রং পান্না সবুজ ৷আন্দামানের সব বিচ স্নানের উপযোগী নয় ৷ রাধানগর তেমনই বিচ যা স্নানের উপযোগী ৷ ঢেউ এর আকর্ষনে আর থাকতে পারলাম না নেমে পড়লাম ৷ দীর্ঘক্ষণ সমুদ্র সোহাগ উপভোগ করলাম ৷ স্নান শেষে সমুদ্র লাগোয়া ধাবায় আহার সারলাম ৷ হ্যাভলকের এলিফ্যানটা বিচে সমুদ্র ক্রিড়ার পসরা সাজানো  ৷ আমরাও সেই দলে ভিড়ে গেলাম ৷ এরপর নীল দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ৷ ধীরে ধীরে হ্যাভলকের সব কিছু মিলিয়ে গেল ৷ একসময় সব মিলিয়ে জল আর জল ৷ প্রায় দেড় ঘন্টার মধ্যে সর্বগ্রাসী নীলের মাঝখান ছেড়ে পৌঁছে গেলাম " নীল আইল্যান্ডে " ৷ 

নীল একটি ছোট্ দ্বীপ ৷ এখানে ও সর্বস্ব হারানো বাংলাদেশি মানুষের আধিপত্য ৷ দ্বীপটি সবুজ বনানীতে ঘেরা ৷ শান্ত , স্নিগ্ধ , নির্জন সাগর তট ৷ আর ফসলে ভরপুর ৷ এখানে ও সমুদ্র ক্রিরায় সাজানো পসরা ৷ ভরতপুর বিচে গ্লাস বোটে চড়ে রং বেরং এর প্রবাল , রঙ্গীন মাছ দেখলাম ৷ সিওয়াক ,স্নরকেলিং , স্কুবা ডাইভিং করার পক্ষে উপযুক্ত ৷ বিচ লাগোয়া দোকানিরা প্রচুর পসরা নিয়ে বসেছে ৷ 
এবার ফেরার পালা ৷ জাহাজ যতো তার গতি বাড়াছে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ যেন গিলে খেতে আসছে ৷ আবহাওয়া খুব খারাপ ৷ মাঝে মাঝে বৃষ্টি ৷ অসম্ভব ঢেউ এর আছাড় আর দুলুনি সহ্য করতে না পেরে অনেকেই বমি করে ফেলছে ৷বার বার ঘড়ি দেখছি আর ঠাকুর কে স্মরন করছি ৷ সময়  কিছুতেই পার হতে চাইছে না ৷ অবশেষে ঘোষনা করল আর মাত্র ৩০মি সময় লাগবে ৷ এবার ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম ৷ দূর থেকে পোর্টব্লেয়ারের আলো দেখতে পেলাম ৷ জাহাজ থেকে নামতে না নামতে আবার ভিজলাম ৷ পরের দিন সকাল ১০ ফ্লাইটে কোলকাতার রওনা দিলাম  ৷ আর সঙ্গে করে নিয়ে আসলাম আন্দামান দর্শনের তৃপ্তির স্বাদ ৷ যে স্বাদ আস্বাদন করতে দেশ বিদেশ থেকে বহু পর্যটক ছুটে আসে ৷ আমিও সেই দলে সামিল হলাম  ৷ 
                      

সমাপ্ত
ছবিঃ লেখিকা


Sunday, August 5, 2018

যখন তখন-ভ্রমণ-কালাপানির দেশ আন্দামান (পর্ব-৩ )-তৃপ্তি মিত্র

কালাপানির দেশ আন্দামান (পর্ব- ৩)

তৃপ্তি মিত্র 

সংখ্যা -২৪, (৬ ই আগস্ট , ২০১৮)


আমাদের গাড়ি মাঝে মাঝে গতি কমিয়ে চলার চেষ্টা করছে যদি গাছের আড়ালে বা জঙ্গলের মধ্যে আবার কিছু জারোয়া দেখতে পাই সেই উদ্দেশ্যে ৷ কিন্তু আমাদের উৎসুক চোখের ক্ষমতা নেই দুশো আড়াইশো ফুট উদ্ধত গাছ কে উপেক্ষা করে তাদের খুঁজে বার করা ৷ আর সম্ভব ও না জারোয়াদের গায়ের রং আর জঙ্গলের ঘন অন্ধকার মিলেমিশে একাকার ৷ ওদিকে আইনের কড়াকড়ি যথেষ্ট ৷ গাড়ির গতি ৪০ কিলোমিটারের নিচে রাখা যাবে না ৷
লাইমস্টোন কেভ

 চালক ভাইয়ার কাছে শুনলাম একসময় " হিউমেন সাফারি " নিয়ে দেশ বিদেশে প্রবল আপত্তির ফল স্বরুপ এই আইনের কড়াকড়ি ৷ সকাল ছটা থেকে তিন ঘন্টা পরপর অর্থাৎ ৬ , ৯ , ১২ , ৩ পুলিশি প্রহরায় গাড়ির কনভয় ছাড়া হয় ৷ এরপর আর কোন গাড়ি এখান থেকে যেতে দেওয়া হয় না ৷ এই পথটুকু যেতে যেতে চালক ভাইয়ার কাছে ওদের গল্পই শুনলাম ৷ জারোয়াদের একাংশ সভ্যতার ছোঁয়া পেয়েছে ৷ ওদের জন্য তৈরি হয়েছে স্কুল ৷ মোবাইল ব্যবহার শিখেছে ৷ হিন্দি , বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারে ৷ তবে উগ্র জারোয়ারা মনুষ্য সমাজে মেশে না বরং সভ্য মানুষদের ঘৃনা করে ৷ কিছু কিছু আবার জঙ্গল ছেড়ে হাইওয়েতে চলে আসে সভ্য মানুষদের থেকে নেশার বস্তু সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ৷ 

দিনদিন জারোয়াদের জনসংখ্যা তলানীতে ঠেকেছে ৷ এই আদিম মানুষগুলি কে টিকিয়ে রাখা এখন বড় চিন্তার ৷ তাই ওদের কল্যাণের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সভ্য মানুষের সংস্পর্শ থেকে ওদের দূরে রাখতে হবে  ৷ না হলে এই জনজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ৷

 নানান গল্প শুনতে শুনতে লোমহর্ষক পথ অতিক্রম করে আমরা পৌঁছে গেলাম নীলাম্বর " জেটি ঘাট ৷এখানে পারমিট করিয়ে নিয়ে গেল " নয়াডেরা " জেটি ঘাট ৷ এখানে প্রাতরাশ সারলাম তারপর রওনা দিলাম প্রকৃতির বিস্ময় " লাইম স্টোন কেভের " উদ্দেশ্যে ৷ আমাদের স্পীড বোট ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে মনের মধ্যে উৎসাহ ভয় দুটো মিলেমিশে একা কার ৷ একসময় স্পীড বোট  এর গতি কমে গেল প্রায় দেড় কি . মি রাস্তা ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের মধ্যে ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছি ৷ এবার মনের মধ্যে অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ৷ এতো কুমিরের আঁতুড় ঘর ৷ এই না ঘাড়ে ঝাপিয়ে পড়ে ৷ বা লাফিয়ে বোটে উঠে যায় ৷ 

যেতে যেতে পেয়ে গেলাম বনদপ্তরের কাঠের তৈরি আলপথ ৷ বোট ছেড়ে উঠে পড়লাম কাঠের আলপথে ৷ ওরে বাব্বা এখানেও নিস্তার নেই , দুপাশে ঘন জঙ্গল ৷ এতক্ষণ কুমিরের ভয়ে কুঁকড়ে ছিলাম এবার যদি চিতা বাঘ বাবাজী উদয় হয় পালাবার কোন রাস্তাই নেই ৷
কাঠের আলপথ
আর সবুজ সাপ , কেউটে , ময়াল কি কি আছে জানিনা ৷ অগত্যা প্রাণ হাতে নিয়ে গাইড কে অনুসরণ করলাম ৷ মাঝে মাঝে গাইড কে জিজ্ঞাসা করছি আর কতদূর যেতে হবে ভাই ৷ আলপথ শেষ করে এবার সমতল পথ হাঁটছি আর হাঁটছি ৷ বেশ মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠা ছোট্ট একটা গ্রাম ৷ সমতলে যে সব গাছগাছালি হয় সবই আছে ৷ জমিতে নতুন ধান চারা মাথা দোলাচ্ছে মহা আনন্দে ৷ চরে বেড়াছে মুরগি , ডোবায় হাঁসের ঝাঁক , মাঠে গরু , বাছুর ৷ বড় বড় সাইজের নারকেল পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে কোনটা ওখানেই গজ বেরিয়ে পড়ে আছে ৷  গাইডকে অনুসরণ করতে করতে অবশেষে পৌছে গেলাম প্রকৃতির বিস্ময় " লাইম স্টোন কেভ " ৷ এটি মুলত প্রাকৃতিক চুনাপাথরের সঙ্গে বৃষ্টির জলের বিক্রিয়ায় সৃষ্ট যা কিনা বিভিন্ন শেপ তৈরি করেছে , কোনটা দেখে মনে হচ্ছে স্বয়ং শিব ঠাকুর বসে আছে , তো কোন টা হাতি লম্বা শুঁড় তুলে দাঁড়িয়ে আছে যা দেখে এতক্ষণের কষ্ট উৎকন্ঠা সব দূর হয়ে গেল ৷ টপ টপ করে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরছে যা চুনাপাথরের সংস্পর্শে এসে জমাট বেঁধে বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করছে যা পুরোটাই প্রকৃতি নির্ভর ৷ 
শেষে লেবু জল পান করে একই রাস্তায় বিদায় নিলাম ৷ অবশ্য স্থানীয়দের থেকে জেনে নিলাম এখানে বাঘ , কুমীর , ইত্যাদি ইত্যাদি কেউ আছে কিনা ৷ তারা আমাদের নির্ভাবনায় ফিরতে বললো এখানে নাকি ওসব কিছু নেই ৷ 

  এবারের গন্তব্য আর এক বিস্ময় " মাড ভলকান " ৷ এখানের যাতায়ত রাস্তাটা বেশ কষ্টকর ৷ ধাপে ধাপে মাটির সিঁড়ি বানানো ৷ কোনটায় কাঠের টুকরো আছে কোনটায় নেই ৷ বেশির ভাগ জায়গা পিছল ৷  রাস্তার দুদিকে ঘন জঙ্গল ৷ কোন গাইড নেই নিজেদেরই যেতে হচ্ছে ৷ তবে সঙ্গী হল একটি হাড় জিরজিরে সারমেয় ৷ ও কিন্তু পুরো সময়টা আমাদের সঙ্গ দিল ৷ জল ছাড়া সঙ্গে কোন খাবার নেই ৷ ওকে তুষ্ট করতে পারলাম না ৷ " মাড ভলকান " দেখলাম যার থেকে ক্রমাগত মাটির নিচ থেকে উঠে আসছে গরম কাদামাটি ৷ সেই কষ্টকর রাস্তাটি ওঠা যতো সহজ মনে হয়েছিলো নামা ততোধিক কষ্টকর ৷ ধীরে ধীরে আমরা সবাই নিরাপদে নামলাম ৷ গাইড সারমেয় আমাদের পিছন পিছন নেমে এল ৷ নিচে এসে গাড়িতে রাখা বিস্কিট দিলাম সারমেয় কে ৷ আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিল , তাকিয়ে এক ঝলক দেখে নিলাম সারমেয় প্রাপ্য ঘুষ পেয়ে মহাখুশি  ৷

রঙ্গতে রাত্রিবাসের পর সূর্যোদয় দেখলাম রঙ্গতের আম্রকুঞ্জ সাগর তটে ৷ মাছধরায় ব্যস্ত জেলেকে ক্যামেরা বন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ৷ জেলে ভাইয়ের ছবি নিচ্ছি বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল ছবি তোলবা ৷ বললাম হ্যাঁ ৷ সঙ্গে সঙ্গে এতো সুন্দর একটি ভঙ্গি দিল ৷ সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা শট নিয়ে নিলাম ৷ 

কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্যদেব তার সোনার আলোয় জ্বলজ্বল করে উঠল ৷ সেই মোহময়ী আভায় ভেসে গেলাম ৷ প্রাণ ভরে শান্ত স্নিগ্ধ সূর্যের পরশ মেখে বিদায় নিলাম ৷ পথে পড়ল পঞ্চবটী জলপ্রপাত ৷ এরপর এলাম মরিছিদ্রা সাগর তটে ৷ আন্দামানের প্রতিটি সাগর তট ভিন্ন ধরনের ৷ কোনটার সঙ্গে কোনটার মিল নেই ৷ কোনটায় প্রবল ঢেউ , কোনটায় বড় বড় পাথরের চাই , কোনটা শান্ত রূপালী বালুর চাদর বিছানো ৷ গাইডের নির্দেশ ছাড়া নামা অনুচিত ৷ অনেকক্ষণ এই সাগর তটে কাটালাম ৷ পাথরের  গায়ে আছড়ে পড়ছে ফেনিল জলতরঙ্গ ৷ যতদূর চোখ যায় সমুদ্র  আর আকাশ মিলেমিশে একাকার ৷  চোখ , মন সার্থক করে ডিগলিপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ৷  


Wednesday, July 25, 2018

যখন তখন-ভ্রমণ-কালাপানির দেশ আন্দামান (পর্ব- ২)-তৃপ্তি মিত্র

কালাপানির দেশ আন্দামান (পর্ব- ২)

তৃপ্তি মিত্র 

সংখ্যা -২৩, (২৬ ই জুলাই , ২০১৮)

  গন্তব্যস্থল  " রস আইল্যান্ড " 


পোর্টব্লেয়ারের আগে এখানেই ছিল ব্রিটিশদের রাজধানী ৷ ১৮৫৮ - ১৯৪১ পর্যন্ত " রসআইল্যান্ড ছিল ব্রিটিশদের অধীনে ৷ তারপর জাপানিরা এর দখল নেয় ৷ এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে প্রচীন কিছু  ধ্বংসাবশেষ ৷ সেই সময়কার কিছু প্রাচীন ঝুরঝুরে ভেঙ্গে পড়া বাংলো , চুরমার চার্চ , আগাছায় ঢেকে যাওয়া সমাধি ৷ চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে অতীতকে হাতড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম ৷ একসময় এই চার্চেই বাজত পিয়ানো , অর্গানের সুর , চার্চের ঘন্টা ৷ কি অদ্ভুত এখন সেই পরিত্যক্ত দ্বীপে রাস্তা আছে মানুষ নেই ৷ আর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দৈত্যকার কিছু গাছ , আগাছা আর সারিবদ্ধ নারকেল গাছের দীর্ঘশ্বাস ৷  পুরনো ইতিহাসকে খৌঁজার চেষ্টা করলাম ৷ একজায়গায় এসে পেলাও বোধহয়- সেই সময়কার বিমান ধ্বংসকারী কামান  ৷ আর সমুদ্রের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে লাইটহাউস ৷  মাঝে মাঝে আন্দামানের উজ্জল আকাশের রোদে ঝলসে যাবার উপক্রম ৷ তখন দৈত্যের মত বিশাল বিশাল গাছের নিচে শান্তির আশ্রয় ৷ আর শৌখীন নেশা ধরা সমুদ্র বাতাস তো আছেই আর সে সঙ্গে গলা ভেজাতে ডাবের জল ৷  কয়েকটি হরিণ , ময়ূর , খরগোষ চোখে পড়ল ৷ আরো একটু ভিতরে যেতে নজর পড়ল পোড়ো ভাঙ্গাচোরা ঘর বাড়ি আগাছায় ঢেকে আছে  , ভিতরে ঢুকতে সাহস হল না শুনেছি আন্দামানের সবুজ সাপের ছোবল নাকি সাংঘাতিক ৷ এর একটি ছোবল শরীর অবশ করে দিতে পারে নিমেষের মধ্যে ৷ দশ থেকে বারো ইঞ্চি তেঁতুল বিছে , কাঁকড়া বিছে  ৷ যাইহোক, তাদের কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো না বরং প্রচুর হরিণ আর ময়ূরের সঙ্গে দেখা হল ৷ ওরা মানুষের সঙ্গেই হেঁটে চলে বেড়াছে ৷ বেশ কয়েক ঘন্টা এখানে ছিলাম ৷ সুনামির প্রভাবে বেশ কিছু ক্ষয় ক্ষতি চোখে পড়ল ৷  বর্তমানে এই আইল্যান্ডের নামকরন হয়েছে " লক্ষীবাই আইল্যান্ড " ৷  এখান থেকে চলে গেলাম " নর্থ বে আইল্যান্ড " ৷ যেখানে গ্লাসবোট চড়ে দেখলাম সাগরতলের প্রবাল ও রংবেরং এর মাছ ৷ সারাদিন পর ফিরে এলাম পোর্টব্লেয়ারের আস্তানায়, " নাগরিণ টুরিষ্ট লজ " ৷ নাগরিণ বেশ ছিমছাম ঘরোয়া ৷ নাগরিণের মালিক জেমস জয় এর সুযোগ্য পুত্র সুরজই সব দায়িত্ব সামলাচ্ছে ৷ এখানের সমস্ত কর্মী মহিলা ৷ প্রত্যেকের সঙ্গে কম বেশী ভাব জমিয়ে তুলেছি ৷ একজন এসে আলাপ করে গেলেন , বললেন কোলকাতায় থাকেন ৷ কোথায় থাকেন জানতে চাইলে বললেনং বঁনগায় ৷ মনে মনে একটু হাসলাম ৷ একদল টুরিস্টের সঙ্গে আলাপ হল ৷ কোথা থেকে এসেছেন জানতে চাইলে বললেন কোলকাতা থেকে এসেছেন ৷ কোলকাতার কোথায় জানতে চাইলে বললেন " মেদিনীপুর " আবার ও হাসলাম ৷ এরপর থেকে কারো সঙ্গে আলাপ হলে ভয়ে জানতে চাইতাম না কোথায় থাকেন বা কোথা থেকে এসেছেন ৷  আমাদের পরবর্তী গন্তব্য নির্দিষ্ট হল বারাটাং ৷ যথারিতী আমাদের গাইড কাম ড্রাইভার ভাইয়া ( সুভ্রমন্নিয়ম ) হাজির ৷ খুবই ভালো ছেলে মাদ্রাজি ৷ বাংলা খুব একটা বোঝে না ৷ হিন্দীটা ভালো বলে ৷ আমি ওকে ভাইয়া বলে ডাকতাম ও আমাকে ম্যাডাম ৷ ভাইয়ার নির্দেশ মত রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ রওনা দিলাম , যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম "ঝিরকাটাং " চেক পোষ্ট " ৷ মিডল ষ্ট্রেট জেটি ঘাট পর্যন্ত ৪৮ কি.মি রাস্তা জারোয়া রিজার্ভ ফরেষ্ট ৷ এইপথ টুকু সরাসরি পুলিশি প্রহরায় গাড়ীর কনভয় ছুটল ৷ মনে খুব উৎসাহ কখন জারোয়াদের দেখতে পাবো ৷ চালক ভাইয়ার কড়া নির্দেশ কেউ গাড়ী থেকে মুখ বার করবেন না ৷ কোন রকম খাবার দেওয়া চলবে না ৷ ছবি তোলা চলবে না ইত্যাদি ইত্যাদি ৷ গাড়ী খুব হালকা গতিতে চলছিলো ৷ আর সতর্ক দৃষ্টি খুঁজে চলেছে জারোয়াদের ৷ কিছুক্ষন পর সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটল ৷ একটি ট্রাক ভর্তি এক  দঙ্গল জারোয়াদের নিয়ে আমাদের সামনে হাজির ৷ অল্প বিস্তর পোষাক পরা সবাই ৷ আমাদের সঙ্গে হাসি বিনিময় হল ৷ একজন তো হিন্দিতে বললো কোথায় যাচ্ছো ৷ আমরা হাত নেড়ে টাটা কারলাম ৷ ওরাও টাটা করে বিদায় নিল ৷ আমরা যাদের কে দেখলাম আন্দামান সরকারই  টুরিষ্টদের দেখানোর জন্য জারোয়াদের এভাবে নিয়ে আসে ৷ তবে কিছু উগ্র জারোয়া আছে তারা সচারাচর মনুষ্য সমাজে মেশে না ৷ ওরা আরো গভীর জঙ্গলে থাকে ৷ তবে ভাগ্য ভালো থাকলে দর্শন হয়ে যেতে ও পারে ৷ যাইহোক আমরা যে জারোয়াদের দেখলাম তাতেই আপাতত সন্তুষ্ট থাকলাম ৷                       
 -----  চলবে







Main Menu Bar



অলীকপাতার শারদ সংখ্যা ১৪২৯ প্রকাশিত, পড়তে ক্লিক করুন "Current Issue" ট্যাব টিতে , সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা

Signature Video



অলীকপাতার সংখ্যা পড়ার জন্য ক্লিক করুন 'Current Issue' Tab এ, পুরাতন সংখ্যা পড়ার জন্য 'লাইব্রেরী' ট্যাব ক্লিক করুন। লেখা পাঠান aleekpata@gmail.com এই ঠিকানায়, অকারণেও প্রশ্ন করতে পারেন responsealeekpata@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

অলীক পাতায় লেখা পাঠান