গল্প- বৈঠকি
ব্রাত্য জীবন
মিঠুন মুখার্জী
Image Courtesy : Google Images |
সোনার চামচ মুখে নিয়ে
জন্মালেই সবার কপালে সুখ থাকে না। ছয় ষষ্ঠীতে ভাগ্যদেবতা যা লেখার লিখে দেয়, তাকে কেউ
খন্ডন করতে পারে না। কলকাতা শহরের মস্তবড় এক ব্যবসায়ী দীপঙ্কর রায়ের দুই ছেলের
পরে এক মেয়ে। ছেলে পছন্দ হলেও মেয়ে সন্তান তার একদম পছন্দ নয়। বছর পাঁচেক আগে
তাঁর সহধর্মিনী আরও এক সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু সেই সন্তানটি ছিল তৃতীয় লিঙ্গের
অন্তর্ভুক্ত। বাবা এই খবর পাওয়ার পর পন করেন এই সন্তানের মুখ সে জীবনে দেখবে না।
তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন অনাথ আশ্রমে এই সন্তানটিকে চুপিচুপি দিয়ে আসবেন। কথায় যা, কাজেও তাই।
সকলের অমত থাকা সত্বেও মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন নিয়ে যাওয়া হয়। সন্তান যেমনই হোক
মায়ের কাছে সে সন্তানই হয়। সন্তান
হারানোর যন্ত্রণা একজন মা ছাড়া কেউ বুঝতে পারেন না।
আজ সেই তৃতীয় লিঙ্গের সন্তানটি
পাঁচ বছরে পড়েছে। অনাথ ছেলেমেয়েদের মাঝখানে পিতা-মাতা থাকা সত্ত্বেও অনাথের মতো
মানুষ হতে হয় তাকে। এই অপরাধ কার? এদিকে অনাথ আশ্রমে তার নাম হয়
বৃন্দাবনী। তার দুই দাদা যথাক্রমে অরুময় ও রাধেময়, এবং দিদির নাম শ্যামা। অরুময় ও
রাধেময় যমজ হওয়ায় তারা এখন একাদশ শ্রেণীতে পড়ে এবং শ্যামা নবম শ্রেণীতে পড়ে।
ছেলে দুটি দীপঙ্কর বাবুর গর্বের হলেও শ্যামাকে সেভাবে ভালোবাসেন না। একবিংশ শতকে
দাঁড়িয়ে মেয়েরা এখনো যে ব্রাত্য সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ছোট সন্তানের শোকে
তাদের মা অসুস্থ দীর্ঘদিন। তাই তাদের দেখাশোনা করার জন্য দুজন কাজের লোক রেখেছেন দীপঙ্কর
বাবু। এদিকে কোনরকমে অবহেলায় বেড়ে উঠতে থাকে বৃন্দাবনী।
দশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। দীপঙ্কর
বাবুর বয়স হওয়ায় তার কাজকর্ম অরুময় ও রাধেময় দেখাশোনা করতে শুরু করেছেন। এক
উচ্চবংশের ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে শ্যামার বিয়ে দিয়েছেন তিনি। মাঝেমধ্যে ছেলেদের
দিয়ে খোঁজখবর নেন তিনি। পিতার এহেন আচরন শ্যামার চোখে বুক ফেটে জল এনে দেয়। হঠাৎ
অসুস্থ কিছু গুরুতর হওয়ায় শ্যামার মা পরলোক গমন করেন। তার কাজ সম্পন্ন করে
দীপঙ্কর বাবু তার ছেলেদের বলেন-“তোমাদের মার চলে যাওয়ায় আমার মনের শান্তি নষ্ট
হয়ে গেছে, আমি
কিছুদিনের জন্য হরিদ্বারে তীর্থ করতে যাব। তোমরা বড় হয়েছ, ব্যবসা
সামলানোর ক্ষমতা হয়েছে,
আমার আর চিন্তা নেই। তোমাদের কাছে ছেড়ে দিয়ে আমি তীর্থে যেতে চাই”। ছেলেরা
তাদের পিতাকে জানায় তারা পিতার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবেন না।
এদিকে বৃন্দাবনী এখন পনেরো বছরের
যুবতী। তার যৌবন টলমল করছে বটে, কিন্তু সভ্য সমাজের থেকে সে অবহেলিত। নিজের জীবনের দুঃখ
চিরসঙ্গী জেনেও নিজের মতো করে বাঁচার চেষ্টা করে সে। কেউ কেউ তাকে মাসি বলে ব্যঙ্গ
করে। তাতে প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো বৃন্দাবনীর। কিন্তু যত দিন যায় ততই গা
সওয়া হয়ে যায় তার। হিজড়ে মাসিদের দলে
নাম লেখায় সে। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে যা
পাওয়া যায় তাতে তার ভাগে মাসে কুড়ি হাজার টাকার বেশি পড়ে। খাওয়া-পরার অভাব না
থাকলেও জীবনের অধিকাংশ সুখ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় মাঝে মাঝে খুব কষ্ট পায় সে। তার
দলের বদন হিজড়ে, রূপসী
হিজড়ে, ফাল্গুনী
হিজড়ে তাকে খুব ভালবাসে। তার থেকে সকলেই বড় হওয়ায় তাকে স্নেহ করে সকলে।
বৃন্দাবনী জন্মাবার পর যেহেতু তাকে অনাথ
আশ্রমে দিয়ে আসা হয়েছিল,
সেহেতু নিজের বংশ পরিচয় কিছুই জানে না বৃন্দাবনী। পিতা-মাতার অভাব মাঝেমধ্যে
অনুভব করে, কিন্তু
অন্য মাসিরা তার সে অভাব ভুলিয়ে দেয়। একমাত্র শ্যামা ছোটবেলা থেকেই বৃন্দাবনীর
খোঁজ নিত। যখন তার পিতা বৃন্দাবনীকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে এসেছিল, তখন শ্যামা
পিছন পিছন গিয়ে সেটি দেখে ফেলেছিল। তাই বৃন্দাবনীকে একমাত্র শ্যামায় চেনে।
মাসিদের সমাজে আসার পর শ্যামা তার স্বামীকে নিয়ে দুবার বৃন্দাবনীকে দেখতে এসেছিল।
নিজের পরিচয় দেয় নি কষ্ট পাবে বলে। স্বামীকে বিয়ের পরে সব জানিয়েছিল শ্যামা।
এদিকে দীপঙ্কর বাবু হরিদ্বারে তীর্থ করতে
যাওয়ার সুযোগে অরুময় ও রাধেময় নিজেদের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেন, এবং বোনদের
ফাঁকি দিয়ে সম্পত্তি নিজেদের নামে করিয়ে নেন। এখানে বলার প্রয়োজন, দীপঙ্কর
বাবু অশিক্ষিত থাকায়,
একদিন খাবারের সাথে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে সরকারি স্ট্যাম্প পেপারে টিপ সই দিয়ে
নিয়েছিলেন অরুময় ও রাধেময়। দীপঙ্কর রায় বাড়ি ফেরার পর সবকিছু জেনে অসুস্থ
হয়ে পড়েন। পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে প্রচুর রক্ত বেরিয়ে যায়। খবর পেয়ে শ্যামা ও
তার স্বামী আসেন তাদের বাড়িতে। এদিকে পাড়ার লোকে দীপঙ্কর বাবুকে হসপিটালে ভর্তি
করেন। প্রচুর রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার ফলে 'ও নেগেটিভ' রক্তের
প্রয়োজন হয়। শ্যামার ও তার স্বামীর রক্ত 'ও নেগেটিভ' না হওয়ায়
খুব চিন্তায় পড়ে যায় তারা। ডাক্তার বলেছেন-এক ঘণ্টার মধ্যে রক্ত
না দিলে সে তার পিতাকে বাঁচাতে পারবে না।এই কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে শ্যামা।
হঠাৎ করে শ্যামার মাথায় একটা
বুদ্ধি খেলে গেল। সত্বর হিজড়ে মাসিদের পল্লীতে গিয়ে বৃন্দাবনীর সঙ্গে দেখা করে সব
বৃত্তান্ত খুলে বলল সে। বৃন্দাবনীর প্রথম পিতার প্রতি রাগ হয়েছিল, কিন্তু
পরক্ষণেই ভেবে দেখল পিতাকে বাঁচাতে না পারলে কোনদিন সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে
না।
দীপঙ্কর বাবুর অজান্তে বৃন্দাবনীর
রক্তে সেদিনের মত মরতে মরতে বেঁচে গেলেন তিনি। যখন জ্ঞান ফিরল তখন তার পায়ের কাছে
দাঁড়ানো বৃন্দাবনী,
শ্যামা ও শ্যামার স্বামী। শ্যামা তার পিতাকে বৃন্দাবনী সম্পর্কে সব খোলাখুলি
বলে। এরপর দীপঙ্কর বাবু লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, বৃন্দাবনীর
ওপর তিনি এত বড় অন্যায় করেছেন, সেই আজ তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছে। তাঁর এই অসময়ে ছেলেরা একবারের
জন্যও আসেন নি। বৃন্দাবনী চলে যাওয়ার সময় পিতাকে উদ্দেশ্য করে সে শ্যামাকে বলে- “তুমি বললে তাই আমি এখানে এলাম, নতুবা আমি কখনো এখানে আসতাম না।
সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে,
সে সন্তানই হয়। বাবা-মার প্রতি কর্তব্যই প্রমান দেয় সে সুসন্তান, না
কুসন্তান। মেয়েরা পারে না এমন কিছু নেই। আর আমার মত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরও তো
পিতা-মাতাই জন্ম দেয়। তাহলে ঈশ্বরের সৃষ্ট সেই সন্তানের কি দোষ বল তো দিদি?” আমরাও তো
মানুষ। এই কথা বলতে বলতে বৃন্দাবনীর চোখের কোনে জল দেখা যায়। বৃন্দাবনীর পিতা
সকলের সামনে বৃন্দাবনীর কাছে তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বৃন্দাবনী
তার পিতাকে ক্ষমা করেছিল কিনা জানি না, তবে তাঁর প্রতি অভিমান করে নৈশব্দ্যে
হাসপাতাল থেকে হিজড়ে পল্লীর দিকে পা বাড়ায়।
| বর্ষ বরণ সংখ্যা-১৪২৯ | aleekpata.com | 29th Edition |
| ALEEK PATA- Your Expressive World |Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Bengali New Year, 2022 | April-June 2022 | Fifth Year Third Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |