গল্প
সুরের টানে
দেবাশিস্ ভট্টাচার্য্য
রাত আড়াইটে বেজে গেছে, হাইওয়েতে উঠে হু হু করে ছুটে চলছে স্যান্ট্রোটা, পেছনের সীটে পাশে বসে দীপ্যমান ঢুলছে, প্রবীরের চোখও ঘুমে জড়িয়ে আসছে, ড্রাইভার
নারায়ণের পাশে কেউ নেই।
বাকীরা আরেকটা গাড়িতে, সেই গাড়িটা আগে আছে।
অমাবস্যা কিনা কে জানে সামনের
গাঢ় অন্ধকার গাড়ির আলোয় চিরে ছুটে চলেছে স্যান্ট্রোটা। আগের বিশাল বিশাল মালবাহী লরিগুলোর
লাল আলো তাদের গাড়ীর আলোয় জ্বল জ্বল করে উঠছে দানবের চোখের মত। দুপাশে
সম্ভবত ইউক্যালিপটাসের জঙ্গলে গাছগুলো হাত তুলে প্রেতের মত দাঁড়িয়ে আছে গাড়ীর আলো
দূরের গাছগুলোয় পড়ামাত্র তারা তীব্রগতিতে গাড়ীর দিকে প্রবল আক্রোশে ছুটে এসে তারপর
গাড়ীকে পেরিয়ে আরো পেছনে চলে যাচ্ছে। আলো বোধহয় তাদের চোখে সহ্য হয় না। মাঝে মাঝে বিকট হর্ণ বাজিয়ে কোন
গাড়ি উল্কাগতিতে তাদের ওভারটেক করে চলে যাচ্ছে। রাতে এভাবে হাইওয়ে দিয়ে যেতে একদম
ইচ্ছে হয় না।
কিন্তু উপায় নেই। সে
যে প্রবীরকুমার! তার নামে ফাংশনে ভীড় হয়। রাত এগারোটার আগে সে স্টেজে ওঠে না।
“গুরু
ফাটিয়ে দিয়েছ”, “জীও পাগলা”, সিটি, হাততালি, পাবলিকের
উত্তাল নাচ এমনকী নোটের মালা গলায় পরানো এসবই আজও ঘটেছে, অন্য
রাতগুলোর মতই।
অন্য রাতগুলোর মতই সেই গোটা পনেরো গান। যন্ত্র! যন্ত্র! একদম যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। সেই একই
গান একই ভঙ্গিমা রাতের পর রাত। পাল্টায় শুধু জায়গা। আজ ভবানীপুর তো কাল মেদিনীপুর তো পরশু দুর্গাপুর।
কিংবদন্তী গায়কের নকল গায়ক সে। লোকে বলে
অমুক কন্ঠী।
খুব নাম ডাক তার।
কিন্তু সে তো তা হতে চায়নি। সে শুধু গাইতেই চেয়েছিল নানারকম গান, নানারকম সুরে। সুরের তীব্র আকর্ষণেই তো সে ছুটে বেড়িয়েছে। সুর সুর
সুর।
আহা কী মায়া, কী টান সুরের, সে তো চেয়েছিল সুরের স্রোতে ভাসতে। সুরের রঙে রাঙিয়ে নিতে নিজেকে। সে যে
সমস্ত গান গায় তাতেও সুর বড় কম নয়, কিন্তু সে
তো আটকে গেছে ওই পনেরো কুড়িটা গানের সুরে। অথচ কত সুর কত রঙিন ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে তার ধরা ছোঁয়ার
বাইরে।
গ্রামে আগে শহরতলীতে প্রোগ্রাম থাকলে সে সকালেই এসে উপস্থিত হত যদি সেখানকার কিছু
গান সুর সে শিখে নিতে পারে, কিন্তু তাকে
দেখতেই লোকে ভীড় করে তার গানই শুনতে চায় সবাই, তাকে
কেউ গান শোনায় না।
স্টেজে কতবার চেষ্টা করেছে তার বড় প্রিয় গানগুলো শোনাতে, কেউ
শুনতে চায়নি।
তার ম্যানেজার ও সবসময়ের সঙ্গী দীপ্যমানও ওই গানগুলো গাইতে বারণ করেছে। বড় ক্লান্ত, নিঃস্ব লাগে আজকাল।
একটা আলোর বলয়ের মধ্যে ঢুকে
পড়েছে পুটু, চোখ ধাঁধানো আলোর মধ্যে দিয়ে তীব্র
গতিতে সে চলে যাচ্ছে আরো ভেতরে, আলোর বলয়টা
এখন এক গভীর অতল গহ্বর, নিজের পতন
আটকাতে দুহাত বাড়িয়ে কিছু ধরার চেষ্টা বিফলে যায়, কারণ
আলো ছাড়া কিছুই নেই সেখানে। পেটা ঘড়ির ঢং শব্দের পর যে অনুরণনটা ছড়িয়ে পড়ে সেই
অনুরণনটা ছড়িয়ে পড়ছে তার কানের মধ্যে দিয়ে মস্তিষ্কের কোষে কোষে, আর সেটা বেড়েই চলেছে। দুহাতে কান চাপা দিতে চায় সে, ততক্ষণে
আলোর রঙ পরিবর্তন হয়েছে।
এখন আলোর রঙ হালকা গোলাপী। রঙের সাথে সাথে শব্দেরও পরিবর্তন হয়েছে। এখন পেটা
ঘড়ির আওয়াজের অনুরণন নয়, মন্দিরের
ঝোলান ঘন্টার ঘন্টাধ্বনি, একটানা একশ
ঘন্টার আওয়াজ তার মাথার ভেতরে তুফান তুলেছে। আবার রঙ পরিবর্তন, এবার
আলো মৃদু, শেষ বিকেলের মরা রোদের মত, পরিবর্তন শব্দেরও, এবার কেমন
মৃদু চেনা মনখারাপ করে দেওয়া গানের সু্র, কিন্তু
গানটা চিনতে পারে না।
সুরটা লক্ষ্য করে ছুটতে থাকে ধান ক্ষেতের আলের ওপর দিয়ে। আরে কখন আলোর গহ্বরটা পেরিয়ে চলে
এসেছে ধানের ক্ষেতে! এই তো একতারার আওয়াজ আর সেই গানের সুর! ওই তো দূরে বাউল
ফণীকাকা গাইতে গাইতে চলেছে,
“প্রাণপাখী
উড়ে যাবে পিঞ্জর ছেড়ে
ধরাধামে সবই রবে তুমি যাবে
চলে”
ছুটতে ছুটতে ধরে ফেলে
ফণীকাকাকে, ডাকে না, পেছন
পেছন চলতে থাকে।
গানের কথাগুলো মগজে গেঁথে নিতে থাকে, সুর রঙে
ভরিয়ে তাকে ভাসিয়ে নিতে চায়। ফনীকাকা কোথায় থাকে সে জানে না। অনেকদিন বাদে বাদে আসে। সামনে এখন
আর ফণীকাকা নেই আছে সুর, কী টান সে
সুরের, তারই পেছন পেছন চলতে থাকে পুটু। সুরপাখী
নানা রঙের পালকওয়ালা ডানা মেলে দেয়, সাথে সাথে
পুটুও দৌড়তে থাকে।
কিন্তু সুরপাখী মিলিয়ে গেল পুটু ধরতে পারল না। কানে আসে আবার সুর, পাখীটা কি ফিরল? ওমা! কোথায়
পাখী? পুটু এখন ধানক্ষেতের মাঝে নেই, সে দাঁড়িয়ে আছে একটা চড়াপড়া নদীর ধারে। বাঁয়ে বালি, ডাইনে
বালি, মাঝেও বালি, সেই
বালির মধ্যে দিয়ে বহুকষ্টে এঁকেবেঁকে এদিক ওদিক করে রাস্তা বের করে তিরতির করে বয়ে
যাচ্ছে নদীটা।
“মাঝি
বাইয়া যাও রে
অকূল দরিয়ার মাঝে আমার ভাঙ্গা
নাও রে...”
নদীর জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে
আপনমনে গেয়ে চলেছে মইদুলদাদা। কোনকালে নাকি তার দাদাজান নৌকা বাইত এই নদীতে। আজ গোড়ালি
ডোবা জলে দাঁড়িয়ে ভাটিয়ালি গাইছে মইদুলদাদা। পাড়ের নলবন পেরিয়ে বালির চড়ায় নেমে মইদুলদাদার পাশে
দাঁড়িয়ে হাঁ করে গান শোনে কিংবা গিলতে থাকে পুটু। সন্ধ্যে নেমে এসেছে, কালো চাদরটা দিয়ে এখনো চারধারটা মুড়ে ফেলেনি। গানের সাথে
সাথে যেন আশপাশটায় নানা রঙ খেলা করে উঠছে। তার চোখের সামনে বাতাসে যেন মৃদু ঢেউ খেলছে। সরু সরু
রঙের বৃত্ত তৈরি হচ্ছে, ভাঙ্গছে, আবার তৈরি হচ্ছে।
পুটুর দিকে চোখ পড়তে গান
থামায় মইদুলদাদা।
প্রথমটায় যেন চিনতে পারে না, তারপর বলে, “এই সন্ধ্যের মুখে এখানে কী করছিস? যা
ঘর যা।
সাপে কাটলে আর দেখতে হবে না”। তা সাপ আছেও বটে বিস্তর এ তল্লাটে।
“গান
শুনছিলাম গো। কী
ভাল গাও তুমি!”
“তুই
গান গাইতে পারিস? শোনা একটা, না
শোনালে মামাকে বলে দেব একা একা নদীর চড়ে এসেছিস” পুটুর হাত ধরে নদীর পাড়ে উঠে
গাঁয়ের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে মইদুলদাদা। দিনের আলো ফুরিয়েছে, তখন
বেশ বড়সড় চাঁদ আকাশে, পৃথিবীটা রূপোলী আলোর চাদরে ঢাকা, দূরের গাছপালা, ঘর চালা, রূপোলী চাদরে মায়াবী কালো নকশা।
“মাটির
পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রে
কান্দে হাসন রাজার মন ময়না রে
মায়ে বাপে কইর্যা বন্দী খুশীর
মাজারে
লালে ধোলায় হইলাম বন্দী
পিঞ্জিরার ভিতরে রে”
পুটু লজ্জা ঝেড়ে ফেলে গান ধরে, মইদুলদাদাকেই সে এই গান গাইতে শুনেছিল। কব্জিতে মইদুলদাদার মুঠি ক্রমশই
শক্ত হচ্ছে দেখে মইদুলদাদার দিকে তাকিয়ে পুটু অবাক হয়ে দেখে মইদুলদাদার চোখ দিয়ে
জল পড়ছে, চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে মইদুলদাদার
গাল বেয়ে গড়িয়ে আসা জলের দাগ। তার নিজের চোখেও জল চলে আসে।
“বড়
ভালো গাইছিস, যা সাবধানে বাড়ি যা” বলে ঝাঁকড়া
বটগাছটার কাছে এসে মইদুলদাদা বাঁদিকে গেল আর পুটু ডান দিকে।
“ছটফট
ছটফট করে মজবুত পিঞ্জরা
ময়না ভাঙ্গিতে না পারে রে
কান্দে হাসন রাজার মন ময়না রে
হায় রে কান্দে...”
“হারামজাদা
মা বাপকে খেয়ে হয় নি, এবার আমাকে খাবি?” মামীর হুঙ্কার আর কানে প্রবল টান পড়ায়, তীব্র ব্যথায় পুটুর গান থেমে গেল। পিঠে গোটা কতক কিলও এসে পড়ে। কানের
গোড়ার মত চুলের গোড়া শক্ত না হওয়ায় কয়েক গোছা চুল মাথা ছেড়ে মামীর হাতে উঠে গেল।
চাঁদের আলো যেন অনেকটা ফিকে
হয়ে গেল, মেঘে বুঝি বা ঢাকা পড়ল অতবড় চাঁদখানা।
মাথায় টনটনানি, পিঠে কানে কনকনানি নিয়ে সে ঘরে ঢোকে।
“এত
লোকের মরণ হয় তোর মরণ হয়না রে! সাপেও কাটে না তোকে! বাপকে খেয়েছিস, মা কে খেয়েছিস, সকলকে না
খেয়ে ছাড়বি না” মামীর কথা পুটুর কানে গরম সিসে ঢেলে দেয়।
সম্ভবত তার মরণ না হওয়ার
লজ্জাতেই অধোবদনে থাকে।
চোখের জলে জামার বুকের কাছটা ভিজে যায়।
ঘরে এসে আরো চড়, কিল, লাঠিপেটা
চলার পর বাসন মাজা, উনান ধরানো ইত্যাদি কাজও সে করে ফেলে। চোখের বহতা
ধারা আর জ্বলুনিটার একমাত্র কারণ অবশ্যই উনানের ধোঁয়া নয়। রাতে খাওয়া বন্ধ হওয়াটা স্বাভাবিকই
ছিল।
ছোট ছোট মামাতো ভাই বোন দুটো তাকে ভালবাসে, তারা
মায়ের চোখ এড়িয়ে ক’টা নারকেল নাড়ু দিয়ে গেছে। মামী জানতে পারলে ওদের কপালেও দুঃখ
আছে।
মামার দোকান সাঁইথিয়ায়, সপ্তাহে
একদিন বা দুদিন আসে।
মামাও তাকে পছন্দ করে না, নেহাৎ লোকলজ্জার
ভয়ে তুমুল অনিচ্ছায় তাকে পুষছে। তবে মামীর মত অত্যাচার করে না। বারো বছরের পুটু, ক্লাস ফোর অবধি পড়ার পর স্কুল যাওয়া ঘুচেছে। সে স্কুলে
গেলে কে করবে বাড়ির কাজ।
চাষের সময় ক্ষেতে খাটাই বা কে খাটবে! অবশ্য চাষ এখানে বছরে একবারই হয়। বর্ষায়।
একপেট ক্ষিধে আর এক গা ব্যথা
নিয়ে শুয়ে ভাঙ্গা টালির ফাঁক চুঁইয়ে আসা চাঁদের আলো গায়ে মেখে এপাশ ওপাশ করে রাত
কাটায় পুটু।
জোছনাও কি তার গান শুনতে চায়? শোনে কি? হাজার ব্যথা যন্ত্রণাতেও পুটুর আধোঘুমে বা আধোজাগরণে, চেতনে বা অবচেতনে সুরের বর্ণচ্ছটা খেলা করে যায় আর তার
ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।
পরের তিনদিন সে বাড়ির বার
শুধু এই কারণে হয়নি যে, বাড়ির বাইরে
গেলে মামী ঠ্যাং খোঁড়া করার হুমকি দিয়ে রেখেছে, গায়ের
ব্যথা গালে চড়ের দাগ আর কপালের কালশিটেও তার বাড়ির বাইরে না বের হওয়ার অন্যতম কারণ।
“আট
কুঠুরী নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না মহল তায়”
শেষ বিকেলে দূর থেকে ফনীকাকার
গানের কলি শুনেই ছুট ছুট ছুট। ফনীকাকা চলেছে ক্ষেতের সীমা পেরিয়ে সরু পায়ে চলার পথ ধরে
স্টেশন পানে।
ফনীকাকার চলার গতিবেগ ভালই। তার গতির সাথে তাল রেখেই পেছন পেছন চলেছে পুটু, সুর সুর আর সুর! সুরের মায়াজাল টেনে নিয়ে যাচ্ছে পুটুকে।
“মন
তুই রইলি খাঁচার আশে,
খাচা যে তোর কাঁচা বাঁশের।
কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে”
গানে মাতোয়ারা পুটু ফনীকাকার
পেছন পেছন ছোট ছোট দোকানগুলোকে ডাইনে ফেলে, বাঁয়ে
শিবমন্দির ছাড়িয়ে, পুকুর পাড় ধরে স্টেশনে পৌঁছে যায়। ট্রেন এলে, ট্রেনে উঠেও পড়ে, স্টেশনে
ছেড়ে যাওয়ার সময় তার ক্লাস ফোর অবধি পড়া বিদ্যে কাজে লাগিয়ে স্টেশনের নামটা পড়েও
ফেলে ‘পান্ডবেশ্বর’।
ট্রেনে সারাক্ষণ ভীড়ের মাঝে
লুকিয়ে ফনীকাকার গান শুনতে শুনতে সময় কেটে যায়। ফনীকাকাকে অনেকে গান শুনে খুশী হয়ে
টাকা পয়সা দিচ্ছিল। এ
অবধি সব ঠিকঠাক চলছিল, ফনীকাকার কাছে ধরা খেল বর্ধমান
স্টেশনে নেমে।
পুটুর কান্না আর জেদের কাছে হার মানতে হল ফনীকাকাকে।
ফনীকাকা আশ্রয় দিল পুটুকে
কিন্তু তার মনে পুলিশি ঝামেলার ভয়ও ছিল। ফনীকাকা গিয়েছিল পুটুর মামার কাছে। আপদ বিদায়ের খুশীতে মামা মামী
ফনীকাকাকে বলে দিয়েছিল পুটুকে ফেরত আনার দরকার নেই।
একলা মানুষ ফনীকাকার কাছেই
থাকতে থাকতে সুর তাল লয় শিখতে লাগল। নানারকম কষ্ট থাকলেও গানের সাথে সুরের সাথে থাকার আনন্দে
মশগুল ছিল পুটু।
বর্ধমানেই নানারকম গান
নানারকম সুরের সাথে পরিচয় হতে লাগল পুটুর। মোড়ের পানের দোকানের হিন্দী গান, পূজোপার্বনে
মাইকে হিন্দী বা বাংলা গান আর সঙ্গে ফনীকাকার বাউল গান ছিলই। কোনটা বাউল গান, কোনটা আধুনিক জেনেছিল ফনীকাকার কাছে। ফনীকাকা অবশ্য বাউল গান ছাড়া কিছু
গাইত না।
ফনীকাকার কাছে গান শেখা তার কাছে অমূল্য অভিজ্ঞতা। ফনীকাকা কক্ষণো তাকে মাধুকরীতে
সঙ্গে নিত না, যতদিন না ফনীকাকার শরীরে কাশির সাথে
রক্ত বের হওয়ার অসুখটা বাসা বাঁধল। ফনীকাকা মাধুকরীতে বের হলে সে রাস্তায় রাস্তায় গান শুনে
বেড়াত।
অসুখটা হওয়ার পর আর ফনীকাকা সেভাবে গাইতে পারত না তখন সাথে নিত পুটুকে। সেই পুটুর
পুরো দস্তুর গান গাওয়া শুরু।
তারপর একদিন ঝড় বৃষ্টির রাতে
ফনীকাকা শেষবারের মত একদম ঠিকঠাকভাবে একটুও না কেশে গুনগুনিয়ে গাইল,
“খাঁচা
ভেঙ্গে পাখি আমার
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার
কোনখানে পালায়।
কেমনে আসে যায়,
খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে
আসে যায়”।
একদম একা হয়ে গেল পুটু। ততদিনে সে
বয়সটা আরো বছর ছয়েক বাড়িয়ে নিয়েছে।
ততদিনে সুরের টানে পুটু পাগল। ট্রেনে
নানাধরনের গান গাওয়া চলছে আর নতুন সুর নতুন গান শুনলেই সেই সুরের আকর্ষণে পাগল হয়ে
ছুটছে।
সেই সুর গলায় না তুলে শান্তি নেই।
কী যে ভাল লাগত, বর্ধমানের গানের স্কুলের একমাথা পাকাচুল ফর্সা দিদিমণি যখন
গাইতেন, ছাত্রদের শেখাতেন। সে চুপ করে
বাড়ির বাইরে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে শুনত,
“তোমার
অভিসারে
যাব অগম পারে,
চলিতে পথে পথে
বাজুক ব্যথা পায়ে”
কখন যে চোখ দুটো নিজের
অজান্তেই ভিজে যেত।
ট্রেনে গান গাইতে গাইতে একটা
ধাক্কায় ছিটকে যায় পুটু, রঙ রঙ নানা
রকম রঙ।
সুর আর সুর।
আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে রঙ বেরঙের সুর ঝর্ণার মত, নানা
রঙের আলোর মধ্যে দিয়ে সে একটা হাউইয়ের মত উঠে যাচ্ছে আকাশে। এ আকাশ তো সে চেনা আকাশ নয়, একটার পর একটা রঙ, একটার পর
একটা সুর পার হয়ে উঠে যাচ্ছে। কে? না পুটু তো
নয়। এ
তো প্রবীরকুমার।
এখন এ কোথায় এল সে! এ তো আকাশ
নয়।
সন্ধ্যের আলো ছায়া অন্ধকার ঘেরা শহর। রাস্তার আলো জ্বলছে, সামনে
গঙ্গা।
কলকাতার গঙ্গার ধার।
রাস্তার আলো, গঙ্গা পাড়ের আলো, ঢেউয়ের মাথায় পড়ে চিকচিক করছে। গঙ্গায় নৌকা চলছে ঢিমে গতিতে। গঙ্গার
ধারে আলো আঁধারিতে বসে যুবক প্রবীরকুমার, পাশে ভারি
মিষ্টি মায়াকাড়া চেহারার যুবতীটি যেন চেনা চেনা ঠেকছে। হ্যাঁ, চেনাই তো! ও তো তৃণা। প্রবীরকুমারের জীবনসঙ্গিনী হতে পারত কিন্তু শেষ অবধি হয়নি। একচিলতে
আলো রাস্তার দিক থেকে কী করে যেন পিছলে এসে তৃণার বাঁদিকের গালে তেরছা হয়ে পড়েছে। বড় মোহময়ী
লাগছে তাকে।
মৃদু স্বরে প্রবীরকুমার গাইছে,
“পরাণে
বাজে বাঁশি
নয়নে বহে ধারা
দুখের মাধুরীতে
করিল দিশাহারা”
সত্যি সত্যি গান শুনে তৃণার
চোখ দিয়ে ধারা তার গাল বেয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। সুরের আকর্ষণে ছুটেও নাগাল পেল না, তৃণার আকর্ষণে পাগল হয়েও তাকে পাওয়া হল না। আফশোষ তো
আছেই। এ
জীবনে হল না।
যদি একবারের জন্যেও অন্তত ঠিকঠাক সুরগুলো ছুঁয়ে যেতে পারত! ফনীকাকা ফেলে গেল, তৃণা অধরা রইল, সুরও রইল
নাগালের বাইরে।
চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল আলোটা
ক্রমেই নিভে গেছে অনেকক্ষণ, আকাশের
তারাগুলো টিমটিম করতে করতে একটা একটা করে নিভে যাচ্ছে। সেই মহাশূন্য যা এতক্ষণ হাজার রঙে
রঙিন ছিল, যা বহু সুরে মুখর ছিল সে এখন ক্রমেই
রঙ হারিয়ে কালচে, সুর হারিয়ে নিস্তব্ধ। সেই
মহাশূন্যে প্রবীরের অগ্রগতি এখন গতিহীন, দিশাহীন, এলোমেলো বিচরণ। অন্ধকারে পথের সন্ধানও পায় না, স্তব্ধ
মহাশূন্যে সুর অনুসরণ করে এগোবারও উপায় নেই। নিভন্ত তারাদের দলের শেষ তারাটার আলো নিভে যাওয়ামাত্রই, সেই নিস্তব্ধ নিকষ কালো অতল অন্ধকার গ্রাস করে নিতে থাকে
প্রবীরকে।
দ্রুত, অতি দ্রুত, কালো, আরো কালো, গহীন গভীর
অতল অন্ধকারে হু হু করে তলিয়ে যেতে থাকে সে।
ড্রাইভার নারায়ণ আর চেষ্টা
করেও চোখ খুলে রাখতে পারছিল না, কেউ যেন জোর
করে তার চোখ দুটোকে বন্ধ করে ঘুমের দেশে তাকে ডুবিয়ে দিল। তার পা অ্যাক্সিলারেটরে আরো জোরে
চেপে বসল।
উল্কার গতিতে স্যান্ট্রোটা
যখন সামনের দৈত্যাকার ট্রেলারটার পেছনে আছড়ে পড়ে তিনজন ঘুমন্ত আরোহীকে নিয়ে দলা
পাকিয়ে ট্রেলারটার নীচে ঢুকে যাচ্ছে তখন মহাশূন্যের অতল অন্ধকারে হু হু করে তলিয়ে
যেতে থাকা প্রবীর শেষবারের মত হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাইল তার প্রিয় সুরটাকে,
“সকলই
নিবে কেড়ে
দিবে না তবু ছেড়ে,
মন সরে না যেতে
ফেলিলে একি দায়ে...”
সেই মুহূর্তের প্রবীরের
ঠোঁটের কোণের শান্ত হাসির রেখা আর চোখ থেকে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের রেখা কারো
দেখা হল না।
| ALEEK PATA- Your Expressive World | Online Magazine |
| Editor: Swarup Chakraborty | Publisher: Debasree Chakraborty |
| Bengali New Year 2024 | April-24 | Seventh Year First Issue |
| © All Rights Reserved by The Editor and The Publisher |
| Published By : Aleek Publishers- www.aleekpublishers.com |
| a DISHA-The Dreamer Initiative |